বয়সটাই এমন যে রাজ্যের চারপাশে যা দেখে তাতেই তাদের মধ্যে ভর করে অপার বিস্ময় আর মুগ্ধতা! দেখার মধ্যে দাগ কাটে যা, সেই অভিজ্ঞতাগুলো খণ্ড খণ্ড হয়ে গেঁথে যায় তাদের শিশুমনে।সেই অভিজ্ঞতাগুলো তারা প্রকাশ করে রঙ আর তুলিতে। এলোমেলো আঁকিবুকি হয়ে যায় রঙিন সব ছবি, চোখ ধাঁধানো সব চিত্রকর্ম। বাচ্চামনে কল্পনার বহিঃপ্রকাশ ফুটে ওঠে রঙ তুলির মাধ্যমে।
সারাদিন হোমওয়ার্ক আর টিউটরের চাপে জীবন অতিষ্ঠ-এর মধ্যেই একটু প্রশান্তির খোঁজে রঙতুলির আঁচড়ে ক্যানভাসে ফুটে ওঠে ফুল, পাখি, নদী আরো কত কি!
আবার শিশু মনে এটাও মনে হয় আমাদের স্কুলগুলোর প্রতিটি শিক্ষকই যদি রাম শংকরের মতো হতেন! হাসি-আনন্দ আর গানে ভরপুর! অকারণেই মুখের মধ্যে অদ্ভুত গাম্ভীর্য ধরে রাখতেন না! শিক্ষার্থীদের শুধু মনে করতেন না মার আর ধমকানোর বস্ত! নিজের সন্তানের মতোই যদি আদর যত্ন করতেন! কতই না আনন্দের হত স্কুল জীবন। হৈ-হুল্লোড়, আঁকিবুঁকি, রঙ তুলি এবং মজার উপায়ে পাঠদানে স্কুল পিরিয়ড টা এমন হত যেন বাসাতেই মন টিকত কম। মন বলত কখন স্কুলে যাব।কিন্তু এমনটা বাস্তবে কমই হয়ে থাকে।শিশুরা মনমরা হয়ে স্কুলে যায়। স্কুলে না যেতে চাওয়ার হাজার রকম অজুহাত খুঁজে। খুঁজবেই বা না কেন! স্কুলে তো আর আনন্দ নেই। বাসাতেও সেই একই অবস্থা। সারাদিন স্কুল শেষে বাসাতে এসে একগাদা হোমওয়ার্ক সাথে টিউটরের পড়ার চাপ।
কে এই রাম শংকর? রাম শংকর আমির খান প্রযোজিত ও পরিচালিত সাড়াজাগানো চলচ্চিত্র “তারে জামিন পার” সিনেমার দ্বিতীয় প্রধান চরিত্র যার রুপারুপ করেছেন স্বয়ং আমির খান নিজে। আর ছবিটির প্রধান চরিত্র হলো আট-নয় বছরের স্কুলছাত্র ঈশান আওয়াস্তি। ছবিটি শুরু হওয়ার পর থেকেই আমরা দেখি এক অসহায় স্কুল বাচ্চাকে যে ক্লাসে পড়া দিতে পারে না, জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকে বাইরে, যাকে শিক্ষকরা মারে, বাইরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড় করিয়ে রাখে, শেষে স্কুল থেকেও বহিষ্কার করে দেয়। বাড়িতেও ওর জীবনটা আনন্দময় নয়, বাবা-মা ওকে বুঝতে পারে না। বড় ভাই উহান যখন সব বিষয়ে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে বাড়ি ফেরে, ঈশানের রেজাল্ট শিট তখন কুকুরের মুখে ঘোরে, পড়শি বালকের কাছে মার খেয়ে এসে বাড়িতে উল্টো নালিশ আসায় ওকে বাবার কাছেও মার খেতে হয়।
এমনই এক প্রেক্ষাপট, বাবা-মা স্বভাবতই ঈশানের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়। ওর মনের বিরুদ্ধেই ওকে জোর করে রেখে আসে বোর্ডিং স্কুলে। এ স্কুলে এসেও কি এক মুহুর্তের জন্যও শান্তি পায় ঈশান? শিক্ষকদের বর্বর আচরণে ওর জীবন বিষিয়ে উঠতে থাকে। অবশেষে এই বোর্ডিং স্কুলেই বদলি শিক্ষক হিসেবে আবির্ভাব ঘটে একটি প্রতিবন্ধী স্কুলের শিক্ষক রাম শংকরের, যে কি না চারু ও কারুকলায় পাঠদান করেন। রাম শংকর কিন্তু অন্য শিক্ষকদের মতো রুদ্র কঠিন আচরণে মেতে উঠল না ঈশানের সঙ্গে, ওর দিকে বিরক্তিতে ছুড়েও মারল না হাতের ডাস্টার, বরং হাসিমুখে এগিয়ে এল ওর দিকে।
গভীর মনোযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করে আবিষ্কার করল ঈশান ডিসলেক্সিয়া নামের একটি রোগে ভুগছে। যে কারণে ও কোনো কিছু পড়তে পারে না, অক্ষরগুলো ওর সামনে নেচে বেড়ায়, মাকড়সার মতো ঘোরে। তারপর? না, তারপর আর আমি বলব না। যারা ছবিটি দেখেছেন তারা তো জানেনই, যারা দেখেননি, তাদের অবশ্যই দেখতে হবে। কেননা, এ সিনেমা আপন সন্তানদের প্রতি আমাদের মানবিক হতে শেখায়, ওদের প্রকৃতভাবে ভালোবাসার ইন্ধন জোগায়। আর এ ছবি শিক্ষকদের নিজেদের বিবেকের মুখোমুখি করে তোলে, আত্মদাম্ভিকতা থেকে বেরিয়ে আসার প্রেরণা দেয়। পুলিশ হলেই হাতে লাঠি রাখতে হবে? শিক্ষক হলেই হাতে ঘোরাতে হবে বেত? মান্ধাতার আমলের এইসব অন্ধ চক্কর থেকে বেরিয়ে না এলে কিভাবে শিক্ষকরা আশা করেন তারা নির্মাণ করতে পারবে সভ্য সমাজ! আজ তাদের প্রমাণ করার সময় এসেছে, শাসন করা তারই সাজে, ভালোবাসে যে!
এতক্ষণের রিভিউ পড়ে কারো কারো কাছে মনে হতে পারে, তারে জামিন পার বুঝি শিক্ষণীয় বা ভাবগম্ভীর গোছের কোনো ছবি। মোটেও তা নয়, শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এটা দারুণ উপভোগ্য। ২০০৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত বলিউডের এ সিনেমাটির কাহিনী অমলে গুপ্তের, যা প্যাট্রিসিয়া পোলাক্কোর বই “Thank You, Mr. Falke” ২০০৭ থেকে অনুপ্রাণিত।
ছবিটির একটি স্লোগান রয়েছে-প্রত্যেক মানুষই স্পেশাল। তার বিশেষ কিছু না কিছু গুন আছে। আর সেটাই আবিষ্কারের দায়িত্ব শিক্ষকের।তেমনই ঈশানের ছিল একটি বিশেষ গুন। ঈশান ছিল নিজের কল্পনা জগতের হিরো। ওর কল্পনাতে যা কিছু ঘুরত সবকিছুই সে রুপ দিত ছবি আঁকিয়ে। অসাধারণ সব চিত্রকর্ম সে অনায়াসেই করে ফেলতে পারত। তার পছন্দের তালিকায় ছিল রঙ,তুলি,কাগজ যাতে সে তার কল্পনার দুনিয়াকে ফুটিয়ে তুলত। তার জীবনের স্বস্তির সময়টুকুই হত তখন, যখন সে রঙ তুলি নিয়ে বসত। রঙ দিয়েই সে সকলের মন জয় করেছিল, হয়েছিল সবার চোখের মণি। সবাই চিনল তাকে এক নামে।
রঙ জিনিসটা এমন একটি জিনিস যা শিশুর হাসির কারণ হয় নিমিষেই। রঙ নিয়ে খেলতে ভালবাসেনা এমন শিশু খুঁজে পাওয়া কঠিন। শিশু মানেই রঙ, শিশু মানেই রঙিন। শিশুর জগৎটাই রঙিন। শিশুর কল্পনা হয় রঙিন। আর সেই শিশুর জীবন থেকে আমরা রঙ কেড়ে নিয়ে তাদের জীবন করে তুলি ধূসর।তাদেরকে বইয়ের বোঝা চাপিয়ে দিয়ে সারাদিন পড়ার টেবিলে ফেলে রাখি।পড়ার টেবিল হয়ে যায় তাদের কাছে তিক্ততার প্রতীক। অথচ আমাদের উচিত এই গৎবাঁধা নিয়মের বাইরে গিয়ে তাদের নিজের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দেওয়া। প্রতিটা শিশুকেই বইয়ের সাথে হাতে তুলে দেয়া উচিত তাদের পছন্দের রঙ যাতে করে তারা রাঙাতে পারে নিজের কল্পনাকে নিজের খাতায়। সাদা কাগজটি করতে পারে শিশুর মনের মত রঙিন।নিজের পড়ার টেবিলটিও তখন হতে পারে নিজের সবচেয়ে পছন্দের জায়গা।
লেখাটি নিয়ে মতামত