প্রথম ইনিংসে ৫৯। বলতে গেলে একাই লড়েছিলেন। তাতে অবশ্য ফলোঅন এড়ানো যায়নি। ইনিংস হারও চোখ রাঙানি দিচ্ছিলো। ধুরন্ধর অজি ক্যাপ্টেন স্টিভ ওয়াহ আবারো ব্যাট করতে পাঠান ভারতকেই।
৪৪৫ রানের বিপরীতে ১৭১ করতে পেরেছিলো ভারত। ২য় ইনিংসে ৫২ রানে এক উইকেট হারানোর পর ক্রিজে আসেন লক্ষ্মণ। খুব আশাবাদী ভারত ফ্যানও ড্র হওয়ার আশাও হারিয়ে বসেছে তখন। পুরো অজি টীম যেন অদৃশ্য এক ক্রুর হাসিতে মগ্ন। ভারতীয় শিবির তখন কপাল ভাজের অ্যাম্বাসেডর।
তারপর….. তারপর যা হলো সেটাকে ক্রিকেটীয় পরিভাষায় বললে Rest is history, they said. লক্ষ্মন অথবা লক্ষ্মণ ও দ্রাবিড় রচনা করলেন ক্রিকেটের অন্যতম সেরা ‘বাস্তব ‘ রূপকথার। স্টিভ তো ম্যাচ শেষে বলেই দিলেন, তাঁর দেখা সেরা ক্রিকেটীয় ইনিংস লক্ষ্মণের ঐ ২৮১ রান। উইজডেনও খুব একটা আপত্তি করছেনা স্টীভের সাথে। তারাও জানাচ্ছে, সর্বকালের সেরা ইনিংসগুলোর মধ্যে লক্ষ্মণের ঐ ইনিংস আছে ৬ নাম্বারে।
প্রায় ৭ ঘন্টা ব্যাট করে দ্রাবিড় আউট হন ১৮০ তে। তবে ভিভিএস নাছোড়বান্দা ছিলেন। ১০ ঘন্টারও বেশী ব্যাট করে ২৮১ করেছিলেন। ফলোঅনে পড়া, নিশ্চিত ইনিংস পরাজয়ের হাতছানি, সেখান থেকে ভারতকে বিশাল লীড এনে দেয়া ; রূপকথার ফিনিক্স পাখি দিয়েও এত কিছু করানো যাবেনা। ভারত সেই ম্যাচ জিতেছিলো। না জিতলে ক্রিকেটের সাথেই অন্যায় হয়ে যেত। লক্ষ্মণের ইনিংসটার এতই মাহাত্ম্য ছিলো, দুই ইনিংস মিলিয়ে হরভজনের ১৩ উইকেটের ( অর্থাৎ ৬৫ শতাংশ উইকেট) গল্প আপনি কোথাও খুব একটা পাবেন না। তাতে অবশ্য হরভজন বেজার বলে শোনা যায়নি মোটেও।
লক্ষ্মণের প্রিয় প্রতিপক্ষই ছিলো অস্ট্রেলিয়া। অস্ট্রেলিয়ানরা সেটা স্বীকারও করে নিতেন। টেস্ট – ওয়ানডে মিলিয়ে ২৩ শতকের ১০ টিই এদের বিরূদ্ধে। তার মধ্যে ওয়ানডের ৬ টি সেঞ্চুরির ৪ টি আবার অজিদের বিপক্ষে। বুঝাই যাচ্ছে, অজিরা লক্ষ্মণকে Tormentor কেন মনে করতেন।
টেস্টে লক্ষ্মণ ১৩৪ ম্যাচ খেললেও ওয়ানডেতে তেমন একটা সুবিধা করতে পারেননি। ৮৬ ম্যাচ খেলেছেন। তাতে ৬ টি সেঞ্চুরি থাকলেও গড় ৩০ এর আশেপাশেই ঘুরঘুর করতো। যেটা ঠিক ভারতীয় মিডল অর্ডার সুলভ গড় নয়। টেস্টে ৪৬ গড় নিয়ে ‘দ্য ওয়ালের ‘ পাশে পিলার সুলভ ভুমিকা রেখে গেছেন অনেকদিন। টেস্টে টেলএন্ডের সাথে খেলে ম্যাচ বের করতে পারায় বেশ সিদ্ধহস্তও ছিলেন। টেস্টে সর্বকালের সেরা ভারতীয় একাদশ উনাকে ছাড়া অকল্পনীয়।
তবে ফিল্ডিং বা নরবড়ে গড় বা ফিটনেস ইস্যু ওয়ানডেতে লক্ষ্মণকে খুব বেশী কিছু দিতে পারেনি। শুধু স্লিপে ফিল্ড করে ওয়ানডেতে হয়তো সার্ভাইভ করা যায় না। তারপরও ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় আসরে জায়গা পেতেই পারতেন লক্ষ্মণ।
ক্রিকেটে এটা একটা বড় পরিহাসের গল্প, ভিভিএস কখনো বিশ্বকাপ খেলেননি বা বলা ভালো খেলতে পারেননি। ক্রিকেটের এই এক সমস্যা সম্ভবত। ফরম্যাট অনুযায়ী এখানে বহু কিছু পাল্টে যায়। শুধু ফরম্যাট গুণেই যিনি টেস্টে চরম আরাধ্য, ওডিআইতে তিনিই চরম ব্রাত্য হয়ে যেতে পারেন ( ভারত জিতেছে এমন ম্যাচে লক্ষ্মণের গড় কিন্তু ৫৬)।
ফুটবলে এমন কোন সমীকরণ আছে? মেসি লা লীগায় যেমন পারফর্ম করে গিয়েছেন, ন্যাশনাল সাইডে এসে তো তাঁকে স্ট্র্যাটেজি পাল্টাতে হয়নি। কিংবা রোনালদো, নেইমার সবার ক্ষেত্রেই তাই।
তাই টেস্টের ভাষা কেবল কৌলিন নয়, মাঝে মাঝে তা বোঝাও বটে। লক্ষ্মণ অবশ্য এখানে একা নন। বেশ এলিট কিছু মানুষ লক্ষ্মণের সঙ্গী। যারা বিশ্বকাপ খেলতে না পারাটা একটু বিস্ময়েরও। অ্যালিস্টার কুক, জাস্টিন ল্যাঙ্গার বা ম্যাথু হগার্ড। তবে তাঁদের ব্যাপারটা হয়তো লক্ষ্মণের মত বিরূপ নয়। এরা হয়তো চাইলেই পারতেন খেলতে, আর লক্ষ্মণ চেয়েও পারেননি।
ক্রিকেট বা ফুটবল আসলে টীম ওয়ার্কেরই খেলা। লক্ষ্মণ হয়তো সেখানে ফিট হতেন না, অন্তত ওডিআইতে ফিল্ডিং এর নিরিখে । এসবই অবশ্য নিন্দুকের কথা। ১২০ এর অধিক ক্যাচ অবশ্য ভিন্ন কথাই বলে। তবে ওডিআইতে শুধু স্লিপে ফিল্ড করে হয়তো কাজ হয় না আর ৩০ গড়, যেটা আগেই বলেছি, নামের প্রতি হয়তো সুবিচারও করছিলো না। আর টেস্টেও বিশ্বকাপ বলে কিছু নেই। অধুনা টেস্ট চ্যাম্পিয়নশীপ বলে একটা ব্যাপার যোগ হয়েছে। তবে, তাতে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটার গ্যারান্টি টুকুও নেই।
নিজেকে একটু অভাগাও ভাবতে পারেন লক্ষ্মণ। ভারতীয় টীমে রব উঠেছিলো ২০১১ বিশ্বকাপে, আমরা শচীনের জন্য বিশ্বকাপ জিততে চাই। কিন্তু লক্ষ্মণকে টীমে চাই বা বিশ্বকাপ টীমে চাই এমন কোন Chant লক্ষ্মণ পাননি, হোক সেটা ২০০৩ এ বা ২০০৭ এ। কম্পিটিটিভ ক্রিকেটের বুঝি এই এক গেরো। তুমি নেই মানেই তো ঐ স্লট আমার হতে পারে।
ক্রিকেট এমনই, কোথাও আপনাকে ১০ ঘন্টা ব্যাট করতে হতে পারে, আর কোথাও হয়তো ১০ মিনিটেই ম্যাচ বের করে আনতে হতে পারে!
লেখাটি নিয়ে মতামত