মাঝনদীতে নৌকা চলছে! হ্যাজাকের আলো নিভু নিভু। সবার চোখে-মুখে চাপা আতংক। এই বুঝি হায়েনার গুলি ঝাঝড়া করে দিয়ে গেলো কারো বুক। হিন্দু বাড়ীর অতসী যেমন আছেন, আছে মোল্লা বাড়ীর ইমাম সাহেবও। পরিচয় এসব ঘুচিয়ে তখন কেবল একটাই। শত্রুর হাত থেকে পালিয়ে বাঁচার পরিচয়। চারপাশে টহল দিচ্ছে শত্রুসেনা। এমনিতে বৈঠা হাতে নিলেই গায়েন হয়ে উঠে বদল মাঝি। তার কন্ঠে নদীতে যেন প্রাণ জাগে। সুরে আর কলকল ধ্বনিতে অপরূপ পরিবেশ সৃষ্টি হতো। তার কিছুই হচ্ছে না এখানে।
কাল রাতেই অতসীর ঘরে ওরা ঘুরে গেছে একবার! মোল্লার বউকেও শাসিয়ে গিয়েছে। আর আজ তো উত্তর পাড়ায় দুই হিন্দু বাড়ীতে আগুণই লাগিয়ে দিয়েছে। সবার ভাবনায় ছেদ পড়লো একটু। অতসীর বাচ্চাটা কেঁদে উঠলো। সে কী গগনবিদারী কান্না! নৌকায় সবাই তটস্থ। সে কী কারবার! এই কান্না শুনলে তো পাকিস্তানিরা জেনে যাবে নৌকার লোকেশন। হঠাৎ এক লোক বলে উঠলো, ‘ এই বাচ্চা তো আমাদেরও বিপদে ফেলবো ‘। এর কান্না থামান। কেঁপে উঠে মা অতসীর বুক। বদল মাঝির যে কন্ঠ কেবল সুরেলা গানই বুঝতো সেও হঠাৎ কঠোর হয়। প্রাণপণে মা অতসী শিশুর মুখ চেপে কান্না থামানোর চেষ্টা করে।
এমনই চেপে ধরা ছিলো, সেই ছোট্ট শিশুটির আর কাঁদার দরকার পড়েনি। হাসি-কান্নার উপরে উঠে যায় শিশুটি। বদল মাঝির গানও আর শোনেনি নদীপাড়ের মানুষ। মোল্লা বাড়ীতে এসেছিলো কিনা তাও আর জানা যায়নি। এমন ঘটনা আমাদের যুদ্ধে হরদমই ঘটেছে। বহু হৃদয়বিদারক ঘটনায় একটি মহাকাব্য রচিত হয়েছিলো। রূমীর কথা তো আগেই জানো তোমরা। শহীদ জননী বলেছিলেন, ‘ যা তোকে দেশের জন্য কুরবানি দিলাম ‘। কতই বা ছিলো বয়েস তার? তোমাদের চেয়ে বড়জোর কয়েক বছরের বড়। হেসে খেলে কাটানোর সময়টাতে সে দেশের জন্য লড়েছে।
গহীনে শব্দ চলচ্চিত্রটা তোমরা দেখতে পারো অনায়াসেই। খালিদ মিঠু কি সুন্দর করে আমাদের শিশু-কিশোরদের চিত্রায়িত করেছেন। তোমাদের যদি বলি, আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের একটা বিশাল অংশ ছিলো আমাদের শিশু- কিশোররাই। এতে অবাক হবে না নিশ্চয়ই তোমরা। আর যদি বলি সেই সংখ্যাটা প্রায় পাঁচলাখ, তবে কেমন লাগবে। নির্যাতিত নারীদের মধ্যেও একটা বিশাল অংশ ছিলো আমাদের কিশোরীরা।
আসলে এটা হুইসেলের উদ্বোধনী সংখ্যা। আর আমরা এখানে ঝালমুড়ির স্বাদটা দিতে চাইছি আসলে। পেট ভরবে না হয়তো, মুখে লেগে থাকবে বেশ কিছুক্ষণ। আর পেট ভরাতে কী করবো জানো? হ্যাঁ, আমরা সেদিনের ‘ শিশু-কিশোর ‘ মুক্তিযোদ্ধাদের বয়ান নিয়ে আসবো তোমাদের জন্য। সেদিনের সেসব শিশু বা কিশোরদল আজ হয়তো প্রৌঢ় বা বার্ধ্যকে এসে পৌঁছেছেন। কেউ হয়তো আর বেঁচেই নেই। তবে প্রজন্মের সেতুবন্ধনে তাঁরা বেঁচে থাকবেন বহুকাল। যতদিন রবে পদ্মা -মেঘনা -যমুনা ঠিক ততদিন।
প্রজন্মের সেতুবন্ধন হবে তোমাদের এই হুইসেল ম্যাগাজিন। তোমাদেরই তো অথবা তোমরাই হুইসেলের।
লেখাটি নিয়ে মতামত