প্রাণীজগৎ একাধারে যেমন রহস্যের নাম অন্যদিকে তারা নিত্যনতুন ঘটিয়ে থাকে মজাদার সব কাহিনি। প্রাণীজগৎ নিয়ে কিন্তু আমাদের শিশুদের কৌতুহলের শেষ নেই। আর থাকবেই না বা কেন? নানান রঙের, নানান ঢংয়ের প্রাণী দিয়ে সমৃদ্ধ আমাদের এই জগৎ। প্রতিটি প্রাণীরই নিজস্ব কিছু স্বভাব, বৈশিষ্ট্য আছে। কিছু প্রাণীর সেরকম কিছু বৈশিষ্ট্য নিয়েই এই লেখা। তাহলে এরকম মজাদার প্রানীদের কিছু মজাদার বৈশিষ্ট্য জেনে নেওয়া যাক। কি বলো ছোট্ট বন্ধুরা?
ছোটবেলায় আমাদের জীবনের অন্যতম একজন সুপারহিরো ছিল ব্যাটম্যান। যাকে কমবেশি সবাই ই চিনি।এই ব্যাটম্যানের মধ্যে কিসের বৈশিষ্ট্য ছিল জানো তোমরা? হ্যাঁ, ব্যাট বা বাদুড়ের।
- বাদুড় Animalia জগতের Chordata পর্বের Mammalia শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত।
- প্রজাতি সংখ্যা হিসাব করলে স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রজাতি এরা। মূলত এরা নিশাচর প্রাণী।
- মজা কি জানো যে বাদুড়ই একমাত্র স্তন্যপায়ী প্রাণী যে উড়তে পারে। স্তন্যপায়ী এবং উড়তে পারা বিষয়টি কিন্তু বেশ মজাদার। এই পর্যন্ত প্রায় ১১০০ এর ও বেশি প্রজাতির বাদুড় পাওয়া গেছে।
- একটি মাঝারি সাইজের বাদুড় ঘন্টায় যে পরিমাণ পোকা খায় তা একজন মানুষের এক রাতে ২০ টা পিজ্জা খাওয়ার সমান।শুনে খুব অবাক লাগছে না?
- ব্যাট কনজারভেশান ইন্টারন্যাশনালের মতে, ১৫০ টি বাদুড় বছরে ফসলের জন্য ক্ষতিকর যে পরিমাণ পোকা খেয়ে ফেলে তা কৃষককে অন্তত ১ বিলিয়ন ডলার ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করে। তাহলে আমরা বাদুড়কে উপকারী প্রাণী হিসেবেই ধরতে পারি।
- বাদুড়ের সবচেয়ে বড় কলোনী বলা হয় টেক্সাসের ব্র্যাকেন গুহা কে (Bracken Cave, Texas)। ধারণা করা হয় এই এক গুহাতেই প্রায় ২০ মিলিয়ন বাদুড় আছে।
- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আমেরিকানরা বাদুড়কে প্রশিক্ষণ দিয়ে বোমা ফেলার চেষ্টা চালিয়েছিল।
এবার আসি আরেকটি প্রাণী নিয়ে যার নাম উটপাখি।উট আবার পাখি বিষয়টি বেশ অদ্ভুত। অদ্ভুত জিনিস সম্পর্কে জানার আগ্রহ কারই বা না থাকে। চলো এবার উটপাখি সম্পর্কে জানি।
- উটপাখি Animalia জগতের Chordata পর্বের Aves শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত।
- এরা প্রধানত ভেজিটেরিয়ান মানে তৃণভোজী তবে মাঝে মাঝে ছোটখাটো বিভিন্ন অমেরুদণ্ডী প্রাণী শিকার করে থাকে এবং দলবদ্ধভাবে থাকে।
- উটপাখিকে পাখিদের মাঝে সবচেয়ে বড় পাখি বলা হয়। তার মানে উটপাখি সম্পূর্ণই একটি পাখি।
- একটি পুরুষ উটপাখি ৭ ফুট থেকে ৯ ফুট পর্যন্ত হয়ে থাকে এবং মহিলা উটপাখি ৫.৬ ফুট থেকে ৬.৬ ফুট পর্যন্ত হয়ে থাকে।
- উটপাখি কে টিকে থাকার দিক থেকে সবচেয়ে পুরনো পাখিও বলা হয়। ১২০ মিলিয়ন বছর ধরে তারা পৃথিবীতে টিকে আছে।
- উটপাখির লাথি একজন মানুষের মৃত্যুর জন্য যথেষ্ট। তাহলে তো বলতেই হয় উটপাখি অনেক বেশি শক্তিশালী একটি পাখি।
- উটপাখির নামের মধ্যে উট থাকলেও উটপাখি দৌঁড়াতে পারে ঘোড়ার মতো। এটি ঘণ্টায় ৪৩ মাইল বেগে দৌঁড়াতে পারে এবং পুরুষ উটপাখি সিংহের মত গর্জন করতে পারে। এক পাখিতেই কত কি!মজাদার প্রাণী বটে !
- স্থলজ প্রাণীদের মধ্যে উটপাখির চোখই সবচেয়ে বড় চোখ। এতটাই বড় যে এর মস্তিষ্কের পরিমাণ চোখের চেয়ে কম।
- উটপাখি এবং জেব্রা কিন্তু খুব ভাল বন্ধু। এরা প্রায়ই একসাথে থাকে, নিজেদেরকে শিকারী হতে রক্ষা করার জন্য। কারণ উটপাখির দৃষ্টিশক্তি জেব্রা হতে ভালো আবার জেব্রার ঘ্রাণ এবং শ্রবণশক্তি উটপাখি হতে উন্নত। যার কারণে দুজনই দুজনকে সাহায্য করতে পারে।
- আরেকটা জিনিস জেনে ভাল লাগবে যে উটপাখি ডিম পাড়ার পর সেই ডিম দিনের বেলায় মহিলা উটপাখি তা দেয় এবং রাতের বেলায় পুরুষ উটপাখি। জন্মের আগ থেকেই সন্তানের দায়িত্ব ভাগাভাগি করে নেয় তারা। স্মার্ট পাখি এরা।
এবার আসি বিশালদেহী প্রাণী হাতির প্রসঙ্গে।
- হাতি Animalia জগতের Chordata পর্বের Mammalia শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত।
- হাতি একমাত্র স্তন্যপায়ী যে লাফাতে পারেনা।
- একটি হাতির দাতের ওজন প্রায় ৯ পাউন্ড। এত বড় দাঁত অন্য কোনো প্রাণীর দেখা যায় না।
- আমরা কফি খেতে পছন্দ করি।আমাদের পছন্দের একটি কফি ব্ল্যাক আইভরি কফি (Black Ivory Coffee) নামক এক বিখ্যাত ব্র্যান্ডের কফি প্রস্তুত হয় হাতির বর্জ্য থেকে।
- হাতির একটি বিশেষ গুন হলো হাতি মোটামুটি প্রায় ১২ মাইল দূর থেকে কোথাও পানি থাকলে বুঝতে পারে।
- দিনে গড়ে মাত্র ২/৩ ঘন্টা ঘুমায় এই বিশালদেহী প্রাণী। হাতির বাচ্চা প্রায় ২ বছরের মত পেটে থাকে।
- স্থলে বসবাসকারী স্তন্যপায়ীদের মধ্যে হাতির মস্তিষ্ক সবচেয়ে বড় যা মানুষের মস্তিষ্কের তুলনায় ৩/৪ গুণ বড় যদিও তা আবার হাতির তুলনায় কম ই বলা যায়।
- হাতি খুবই স্পর্শকাতর এবং পরিবারের প্রতি যত্নশীল একটি প্রাণী। পরিবারের কোনো বাচ্চা হাতির কোনো সমস্যা হলে পরিবারের সবাই এগিয়ে আসে এবং তার যত্ন নেয়ার চেষ্টা করে। হাতি অনেক সামাজিক একটা প্রাণীও বলা যায়। যখন পরস্পরের সাথে দেখা হয় তখন এরা শুঁড়ের মাধ্যমে একে অন্যকে শুভেচ্ছা জানায়।
হাতি যেমন বড় পিঁপড়া তেমনই ছোট। পিঁপড়া নিয়ে অনেক কৌতুহল সবার।পিঁপড়া নিয়ে জানব এবার।
- পিঁপড়া Animalia জগতের Insecta শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। এই পর্যন্ত ২০,০০০ এর বেশি পিঁপড়া প্রজাতি পাওয়া গেছে। এন্টার্কটিকা ছাড়া পৃথিবীর সব জায়গাতেই এরা কম বেশি আছে।
- পৃথিবীতে পিঁপড়ার বসবাস অনেক প্রাচীনকাল থেকেই। প্রায় বলা যায় ডাইনোসর যখন পৃথিবীতে রাজত্ব করেছিল তখনও পিঁপড়া ছিল পৃথিবীতে। খুব ছোট হওয়ার কারণে হয়ত বেশি সুবিধা করে উঠতে পারেনি। প্রত্নতত্ত্বববিদদের মতে, পৃথিবীতে মানুষের বসবাস আনুমানিক ২,০০,০০০ বছর থেকে। আর পিঁপড়াদের বসবাস আনুমানিক ১১০-১৩০ মিলিয়ন বছর আগে থেকে। নিজেদেরকে বাঁচিয়ে রাখার বা টিকিয়ে রাখার ক্ষমতা এদের কত বেশি তাহলে বুঝতেই পারছো!
- এই পর্যন্ত সবচেয়ে বড় পিঁপড়ার দৈর্ঘ্য পাওয়া গেছে ২.৪ ইঞ্চির মত। যদিও সেটি ফসিল হিসেবে আবিষ্কৃত হয়েছে।
- পিঁপড়ারা “ফেরোমেন” নামক এক প্রকার রাসায়নিক পদার্থের সাহায্যে নিজেদের মাঝে যোগাযোগ করে। যেমন, কোথাও খাদ্য আছে কিনা কিংবা কোন পথে বিপদ আছে তা অন্যদের জানিয়ে দেওয়ার কাজগুলো এরা এভাবেই সম্পন্ন করে।পিঁপড়া নিজের ওজনের চেয়ে ৩ গুন ভারী কিছুও অনায়াসেই বহন করে নিয়ে যেতে পারে। আর কোনো কিছু টেনে নেওয়ার ক্ষেত্রে নিজের চেয়েও ১০০ গুন ভারী জিনিস এরা টেনে নিয়ে যেতে পারে।
- পৃথিবীতে সর্বশেষ গণনা অনুযায়ী মানুষ আছে প্রায় ৭ বিলিয়ন। কিন্তু সম্প্রতি পরিসংখ্যান অনুযায়ী পৃথিবীতে পিঁপড়া আছে প্রায় ১০ কোয়াড্রিলিয়নের মত [১ কোয়াড্রিলিয়ন = ১০,০০,০০০ বিলিয়ন] যা বোঝা যাচ্ছে, আকার-আকৃতিতে বড় হলে পৃথিবী হয়ত পিঁপড়ার দখলে থাকত।
- পিঁপড়া কখনও ঘুমায় না।
- পিঁপড়ার কোনো ফুসফুস নেই এবং কানও নেই। শোনার জন্য এরা ভূমির কম্পাঙ্ক ব্যবহার করে।
- কিছু পিঁপড়া সাঁতার কাটতে পারে।
- খুবই আশ্চর্যজনক একটি বিষয় হচ্ছে আমাজন-এ কিছু পিঁপড়া পাওয়া গেছে যারা নিজেদের ক্লোন তৈরী করে ফেলতে পারে। একে Asexual reproduction বলা হয়।
এবার জানব আমাদের বহুপরিচিত ঘ্যাঙর ঘ্যাঙরঘ্যান সম্পর্কে অর্থাৎ ব্যাঙ নিয়ে।
- ব্যাঙ Animalia জগতের Chordata পর্বের Amphibia শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। ব্যাঙ উভচর প্রাণী।
- কিছু ব্যাঙ নিজের উচ্চতা থেকে ২০ গুন উচ্চতা পর্যন্ত লাফ দিতে পারে।
- ২০১৪ সালে ব্যাঙের ১৪ টি প্রজাতি আবিষ্কার হয়েছে যারা নাচতে পারে।
- ব্যাঙ পানি পান করে না। শরীরে যে পরিমাণ পানি প্রয়োজন তা ত্বকের সাহায্যে শুষে নেয়।
- ব্যাঙ কখন ঘুমায় তোমরা কিন্তু বুঝতে পারবে না। কারণ ব্যাঙ চোখ খোলা রেখে ঘুমায়।
- মিশরে ব্যাঙকে উর্বরতার প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
- “গোল্ডেন পয়জন ফ্রগকে” সবচেয়ে বিষাক্ত ব্যাঙ বলা হয়। এর সবচেয়ে ছোট আকারের ব্যাঙে যে পরিমাণ বিষ থাকে তা ১০ জন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মৃত্যুর জন্য যথেষ্ট।
- ব্যাঙ প্রায় প্রতি ১ সপ্তাহ অন্তর নিজের গায়ের চামড়া বদলায়। নতুন চামড়া গজানোর পর সাধারণত পুরানো চামড়া খেয়ে ফেলে।
সবার কাছে এক ভীতিকর প্রাণী হলো সাপ। জানব এবার সাপ সম্পর্কে
- সাপ Animalia জগতের Chordata পর্বের Sauropsida শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত।
- সাপের ২৫০০ এরও বেশি প্রজাতি রয়েছে।
- এদের দৈর্ঘ্য ১০ সে.মি. থেকে শুরু করে ২৫ ফুট পর্যন্ত হতে পারে। এন্টার্কটিকা ছাড়া সব জায়গাতেই কিছু না কিছু প্রজাতি পাওয়া যায়।
- সাপ জিহ্বার সাহায্যে গন্ধ নেওয়ার কাজটি করে থাকে।
- সাপের চোখে কোনো পাতা বা আইলিড নেই।
- কিছু সাপ কোনো প্রকার খাদ্য গ্রহণ ছাড়াও প্রায় ২ বছর বেঁচে থাকতে পারে।
- সাপ তার খাদ্যকে কামড়ে খেতে পারে না, পুরোটা একেবারে গিলে ফেলে। এজন্য শিকার একটু বড় হয়ে গেলে গেলার জন্য যতটা প্রয়োজন ততটাই নিজের চোয়ালকে এটি বাঁকিয়ে ফেলতে পারে।
- কিছু সাপ আছে কামড়ে বিষ নষ্ট করা অপ্রয়োজনীয় মনে করে। কামড়ের বদলে শিকার কে চেপে শ্বাসরুদ্ধ করে মারতেই তারা বেশি যুক্তিযুক্ত মনে করে। যেমনঃ এনাকোন্ডা।
- সাপের মেটাবলিজম রেট খুব স্লো হওয়ার কারণে এদের নিয়ম করে প্রতি বেলায় খেতে হয়না। কিং কোবরা এক মাসও কিছু না খেয়ে আরামসে কাটিয়ে দিতে পারে।
- ব্ল্যাক মাম্বা কে বলা হয় সবচেয়ে দ্রুত গতির সাপ। এরা ঘণ্টায় ১২ মাইল বেগে ছুটতে পারে।
- আবার আমরা দুই মাথাওয়ালা সাপের কথা শুনেছি। এটি কিন্তু শুধুমাত্র রুপকথায় নয়। বাস্তবেও এদের অস্তিত্ব থাকতে পারে।
এবার একটু লম্বা প্রাণীতে যাওয়া যাক।
- জিরাফ Animalia জগতের Chordata পর্বের Mammalia শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত।
- লম্বায় ১৮ ফুট পর্যন্ত হয়ে থাকে। এদের দৃষ্টিশক্তি প্রখর।
- মানুষ এবং জিরাফের ঘাড়ের হাড় সংখ্যা সমান।
- জিরাফের গায়ের দাগ দেখে এর বয়স অনুমান করা যায়। বয়সের সাথে সাথে এই দাগ গাড় হতে থাকে। জিরাফের লেজ অনেক লম্বা। এতটাই লম্বা যে এটি দিয়ে জিরাফ অনায়াসেই নিজের কান পরিষ্কার করতে পারে।
- জিরাফের জিভের রঙ কালো। জিরাফ সাধারণত বসেনা। ঘুমানো থেকে খাওয়া, পানি পান, বাচ্চা জন্মদান সবই দাঁড়িয়ে করে থাকে।
- এরা খুব ভালো দৌঁড়াতেও পারে। বিপদ দেখলে প্রায় ৬০ কিলোমিটার বেগেও এরা দৌঁড়াতে পারে।
- এরা এতই লম্বা যে জন্মের সময়ই একটা শিশু জিরাফ প্রায় ৬ ফুটের মত হয়ে থাকে।
- প্রাণীজগতে জিরাফই একমাত্র প্রাণী যাদের জন্মের সময়ই শিং থাকে।
- জিরাফের গায়ের আঁকাবাঁকা দাগ কিছুটা ফিঙ্গার প্রিন্টের মত। দুইটি জিরাফের এই আঁকাবাঁকা দাগের প্যাটার্ন কখন ও একরকম হয়না।
- জিরাফ সাধারণত কোনো শব্দ করেনা। এমন নয় যে তারা শব্দ করতে পারেনা বরং তারা পছন্দ করেনা। জ্ঞানীর মতে, নিঃশব্দ থাকতেই পছন্দ করে তারা।
আজ তাহলে এই পর্যন্তই। পরবর্তীতে আরো কিছু প্রাণী নিয়ে আমরা চলে আসব! জানব সব মজার মজার তথ্য !
লেখাটি নিয়ে মতামত