শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। এই কথাটা আমরা সবাই জানি এবং মনে প্রাণে বিশ্বাস করি। কিন্তু শুধু পাঠ্য বইয়ের শিক্ষা আমাদের কতটুকু বাস্তবিক জীবনে কাজে আসে বা আমরা প্রয়োগ করতে পারি। সেটা বড় একটা প্রশ্ন। আবার শুধু কি পরীক্ষার ফলাফলই শিক্ষার্থীদের মেধা যাচাইয়ের একমাত্র মাপকাঠি। আমি তেমনটা মনে করি না।
সব মানুষই মেধাবী। তবে,সবাই একইসাথে সব বিষয়ে মেধার স্বাক্ষর বহন করে না।প্রত্যেক মানুষের ফিঙ্গার প্রিন্ট যেমন আলাদা আলাদা হয় তেমনি মেধা আলাদা হয়।অর্থাৎ,ব্যক্তিবিশেষে মেধা ভিন্ন ভিন্ন হয়।
আসলে প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখা আমাদের জ্ঞান আহরণের মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত হয়। অর্থাৎ জ্ঞান অর্জনের জন্য পড়ালেখা। আর পরীক্ষা হচ্ছে পড়ালেখার মাধ্যমে আমাদের কতটুকু জ্ঞান অর্জন হলো তা পরিমাপ করার মাপকাঠি। কিন্তু এটা দিয়ে আমরা কারো পুরোপুরিভাবে মেধার পরিমাপ করতে পারি না।
আমাদের দেশে একটা ভুল ধারণা আছে, কোনো শিক্ষার্থী পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করলেই সে মেধাবী শিক্ষার্থী এবং ভবিষ্যতে সে একজন জ্ঞানী মানুষ হবে। কিন্তু আদতে বাস্তবিক ব্যাপারটা এমন না।
কবি সুনির্মল বসু তার কবিতায় স্পষ্ট করে বলেছেন, ‘বিশ্ব জোড়া পাঠাশালা মোর সবার আমি ছাত্র, নানান ভাবে নতুন জিনিস শিখছি দিবারাত্র।’ এখান থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, জ্ঞান আহরণের জন্য সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ হচ্ছে পৃথিবী।
আমাদের স্কুল কলেজগুলোর শিক্ষা কেবল বইয়ের পাতার কালো অক্ষরগুলোতেই সীমাবদ্ধ। আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা এমন অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে যে, তাদের মতে বইয়ের এইসব লেখা গিলে নিলেই সবাই জ্ঞানী মানুষে পরিনত হবে। তবে বাস্তবিক অর্থে এই নিয়ম পুরোটাই ভুল। প্রমথ চৌধুরীর মতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গুলোতে আমাদের লেখাপড়া গিলিয়ে দেয়া হয় এবং আমরা পরিক্ষার খাতায় তা গলধঃকরণ করি। বাস্তবিক অর্থেই তাই।
স্কুল কলেজের এইসব শিক্ষা জ্ঞান আহরণে কখনোই কোনো ভুমিকা রাখে না। একজন ছাত্রের যেসব বিষয়ে জ্ঞান থাকে তা কখনোই লোকচক্ষুর সামনে আনতে পারে না এই শিক্ষাব্যবস্থায়। নিজের জ্ঞানকে কাজে লাগাতে না পেরে অনেক ছাত্র আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় শেষ পর্যন্ত। জীবনে সফলতার জন্য শুধুমাত্র একাডেমিক পড়ালেখার উপর নির্ভর না করাই বুদ্ধিমানের কাজ। অনেক মুনিগণ আছেন যারা একাডেমিক শিক্ষার উপর নির্ভর না করেও জীবনে সফলতা লাভ করেছেন।
আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জীবনী দেখলে আমরা দেখতে পাই তিনি ছোটবেলায় মক্তব, মসজিদ ও মাজারের কাজে বেশি দিন ছিলেন না। বাল্য বয়সেই লোকশিল্পের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে একটি লেটো (বাংলার রাঢ় অঞ্চলের কবিতা, গান ও নৃত্যের মিশ্র আঙ্গিক চর্চার ভ্রাম্যমাণ নাট্যদল) দলে যোগ দেন।
কবি বাসুদেবের লেটো ও কবিগানের আসরে নজরুল নিয়মিত অংশ নিতেন। নিজ কর্ম এবং অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি বাংলা এবং সংস্কৃত সাহিত্য অধ্যয়ন শুরু করেন। একইসাথে হিন্দু ধর্মগ্রন্থ অর্থাৎ পুরাণসমূহ অধ্যয়ন করতে থাকেন। পরবর্তীতে ১৯১০ সালে নজরুল লেটো দল ছেড়ে ছাত্র জীবনে ফিরে আসেন। কিন্তু আর্থিক সমস্যা তাকে বেশি দিন এখানে পড়াশোনা করতে দেয়নি। ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত পড়ার পর তাকে আবার কাজে ফিরে যেতে হয়। প্রথমে যোগ দেন বাসুদেবের কবিদলে। এর পর একজন খ্রিস্টান রেলওয়ে গার্ডের খানসামা এবং সবশেষে আসানসোলের চা-রুটির দোকানে রুটি বানানোর কাজ নেন। কিন্তু তিনি থেমে থাকেননি। নিজের প্রচেষ্টায় হয়েছেন খ্যাতনামা বিদ্রোহী কবি।
আইনস্টাইনের বাসার নাম্বার ভুলে যাওয়ার গল্পটা কম বেশি সবার-ই জানা। গল্পটির একটা গুরুত্ব আছে, পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ একজন বিজ্ঞানী যিনি তার মস্তিষ্ক ব্যবহার করে সারা পৃথিবীর চিন্তার জগতে ওলট-পালট করে ফেলতে পারেন, তার নিশ্চয়ই একটা নম্বর মনে রাখার ক্ষমতা আছে, কিন্তু তিনি তার মস্তিষ্কটিকে তথ্য দিয়ে ভারাক্রান্ত করতে চাইতেন না! আমাদের মস্তিষ্কটি তথ্য জমা রাখার জন্য তৈরি হয়নি, আমাদের মস্তিষ্ক তৈরি হয়েছে তথ্যকে বিশ্লেষণ করার জন্য, তথ্যকে প্রক্রিয়া করার জন্য! সোজা কথায় বলা যায় সমস্যা সমাধান করার জন্য।
কাজেই যখন দেখি ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া করছে শুধু পরীক্ষায় ভালো নম্বর পাওয়ার জন্য; কিন্তু সেটা করতে গিয়ে তার মহামূল্যবান মস্তিষ্কটি অপব্যবহার করে সেটাকে অকেজো করে ফেলছে, সমস্যা সমাধানের ক্ষমতাটাকে নষ্ট করে দেয়া হচ্ছে, তখন অবশ্যই দুশ্চিন্তা হয়। মস্তিষ্ক নিয়ে কথা বলতে হলে ঘুরে-ফিরে অনেকবারই আইনস্টাইনের কথা বলতে হয়। আমরা কোনো কথা বললে সেটা কেউ গুরুত্ব দিয়ে নেবে না; কিন্তু আইনস্টাইন বললে সেটাকে গুরুত্ব না দিয়ে উপায় নেই। আইনস্টাইন বলেছেন, জ্ঞান থেকেও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে কল্পনাশক্তি।
বাস্তবে দেখা যায় এই বাস্তবিক জ্ঞান সম্পন্ন মানুষগুলোকে পাত্তা না দিয়ে বছরের পর বছর বইয়ের কালো অক্ষরগুলো মুখস্ত করে আসা ছাত্রদেরই মর্যাদার চোখে দেখা হয়। তবে একটু ভালোভাবে তাকালে দেখা যাবে আজকের এই সভ্যতার পেছনে ওই পড়ালেখায় অমনোযোগী ছাত্রটা যে পারিপার্শ্বিক বিষয়ে জ্ঞানী ছিলো তাদের অবদানই সবচেয়ে বেশি।
আমাদের দেশে এমন অনেক অনন্য মনীষী ছিলেন যাদের প্রাতিষ্ঠানিক কোনো শিক্ষাই ছিলো না।ভালো রেজাল্ট তো অনেক দূরের ব্যাপার। তবে মহাকাশ হতে শুরু করে ধর্ম বর্ণ প্রায় সব বিষয়ে তাদের অগাধ জ্ঞান ছিলো। যদিও অনন্য ব্যক্তিরা অনন্যই হয়। তাঁরা উদাহরণ হিসেবে ঠিক নয়। তবে তাদের জীবন থেকে এটাই শিক্ষা পাওয়া যায় যে, ভালো রেজাল্টই কেবল মানুষকে জ্ঞানী করতে পারে না।
ডা. জাফরুল্লার বলেন, আমাদের আশেপাশে অনেক শিক্ষিত মানুষ আছে। তবে এদের মধ্যে জ্ঞানী মানুষের অনেক অভাব।
বর্তমানের প্রেক্ষিতে দেখতে পাই অনেক গোল্ডেন প্রাপ্ত শিক্ষার্থী ভর্তি পরীক্ষায় বিশ্ববিদ্যালয় গুলো চান্স পাচ্ছেন না। তাদের একটু ঘুরিয়ে প্রশ্ন করা হলেই যেন নাজেহাল অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে এ থেকে বোঝা যায় নয় কী? একাডেমিক ভাল রেজাল্ট শুধু মূল্যায়ন করেই তাকে জ্ঞানী ভাবা উচিত না। জ্ঞানার্জন হোক সর্বক্ষেত্র থেকেই নয় শুধু পাঠ্যবই। কবি সুনির্মল বসুর কবিতার মত হোক জ্ঞানার্জন।
তাই এটা স্পষ্ট জ্ঞানী হওয়ার জন্য ভালো রেজাল্ট নয় বরং সবকিছু সম্পর্কে অগাধ জ্ঞান থাকা প্রয়োজন আর যেটা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কিংবা ভালো রেজাল্ট ছাড়াও সম্ভব।
লেখাটি নিয়ে মতামত