কাল তো শুক্রবার। কাল আবার মানুষেরা আনাগোনা বাড়বে। কী মজা! টাকা বেশি পেলে রাতের খাবার টা বেশ জমবে। আমি পল্টু। আমার ঘর বাড়ি নেই। ফুটপাত, ফুটওভার যখন যেখানে ইচ্ছে থাকি।মা-বাবাকে কখনো দেখিনি। আমার অনেক বন্ধু আছে।ওরা ও আমার মতো।আমরা যখন যে কাজ পাই তখন সেটাই করি।কিন্তু শুক্রবার আলাদা।এই দিনে আমরা ফুল বিক্রি করি।মানুষের আনাগোনা বেশি থাকায় উপার্জনও বেশি হয়।তাই আমাদের খুশির সীমা থাকে না।
পথে কত মানুষের আনাগোনা। মানুষ কী করে তা দেখতে আমার ভালো লাগে।একদিন একটা ভাইয়ার ফোনে তার ছবি দেখেছিলাম যেখানে মেঘগুলো তার হাতের মুঠোয়।
আচ্ছা এটাও কি সম্ভব?
মেঘ তো আকাশে থাকে সেটা তো অনেক উপরে তা আবার ধরা ছোয়া যায় নাকি! যদি এমন জায়গা সত্যিই থাকে তবে আমিও একদিন যাবো।সাথে বাবলু, মিনি,রাজু ওরাও থাকবে।ওরা আমাকে অনেক ভালোবাসে।সব সময় আমার খেয়াল রাখে।আমি যখন বড় হবো তখন তো আমার কাছে অনেক টাকা থাকবে তখন ওদের সব জায়গায় ঘুরবো।
“কিরে পল্টু ঘুমাস না ক্যান। কাইল আগে উঠতে হইবো তো”, বাবলুর কথায় ধ্যান ভাঙলো।সত্যিই তো এখন না ঘুমালে তো আগে উঠতে পারবোনা।
সাগরের পাড়ে আমি শুধু দৌড়াচ্ছি পেছনে ধাওয়া করছে মিনি।আজ এতো দ্রুত দৌড়াবো যে ও আমায় ধরতেই পারবে না। মিনি অনেক জোরে ডাকছে আমায়। আধো আধো করে চোখ খুলে দেখি আমি আমার জায়গাতেই আছি আর মিনি রাগান্বিত হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।এমা! আমি এতোক্ষণ সপ্ন দেখছিলাম!
যাহ! অনেকটা দেরি হয়ে গিয়েছে। আজ সব গুলো মিলে বকা দিবে আমায়।
ওদের বকাঝকার পর্ব শেষ হবার পর সবাই মিলে বেড়িয়ে পরেছি । প্রতি শুক্রবার রহিম চাচা আমাদের হাতে এক বালতি করপ গোলাপ ফুল ধরিয়ে দেয়।১০ টাকা করে তা বিক্রি করি অর্ধেক টাকা আমাদের বাকি অর্ধেক রহিম চাচার।
” কিরে তোদের এতে দেরি হইলো ক্যান?”
“চাচা আসার সময় পল্টুরে ছোড কুত্তার বাচ্চা দৌড়ানি দিছিলো”- মিনির কথা শুনে ওর দিকে রাগ নিয়ে তাকালাম। ওমা! দেখি মিনির সাথে সাথে সবগুলো হেসে কুটি কুটি।
” অনেক হাসি তামাশা হইছে এইবার ফুলগুলা নিয়া কামে যা সব”। চাচার কথা শেষ হতে না হতেই আমরা সবাই ফুল দিয়ে চললাম তা বিক্রি করতে।
“ওই সব দাড়া কই যামু আইজ?” রাজুর কথার উত্তরে বললাম “আহসান মঞ্জিল”। বাবলুও আমার সাথে তাল মেলালো।অত:পর সবাই গন্তব্যে যেতে শুরু করলাম সাথে তো আমাদের গল্পগুজব আছেই।
আহসান মঞ্জিল বেশি দূর না অল্প সময়েই এসে পরেছি।বাহ কত্তো মানুষ! ” ওই জলদি সবগুলা ভাগ হয়ে একেকজন একেক দিকে যা তাইলে ভালো হইবো” মিনির কথা শুনে বাবলু বললো “দাদি আম্মা জ্ঞান দেয়া শেষ করে তুই তোর কাজ কর”।
তারপর সবাই ভাগ হয়ে গেলাম।আমি একা উত্তরের দিকে যাচ্ছি।
এমা! এতো গুলো ফুলওয়ালা বাচ্চা কই থেকে আসলো।আগে তো দেখিনি।ওদের ঝুড়িও দেখি অনেকটা ফাকা হয়ে গিয়েছে। তাহলে আজ কি আমাদের বিক্রি কম হবে!
কী জানি কী হবে।
একে একে সবার কাছে গিয়ে ফুল দেখিয়ে কেনার কথা বলা শুরু করলাম।কিন্তু অনেক মানুষের হাতেই ফুল দেখা যাচ্ছে। পুরো ২ ঘন্টা ঘুরার পর ৩-৪ টার বেশি ফুল কেউ নিলো না।
ধুর! আজ কপালটাই খারাপ।
তবুও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। হঠাৎ একদিকে চোখ আটকে গেলো।
একটা ছোট্ট ছেলেকে মাঝে নিয়ে তার মা-বাবা তাকে ধরে হেটে চলেছে।মাঝে মাঝে ছেলেটাকে খাইয়েও দিচ্ছে। কই আমার মা-বাবাতো কখনো এভাবে আমায় আদর করেনি।
আমিও না পাগল।যাদের কখনো দেখিনি তারা আমায় আদর করবে কিভাবে।
এখানে থেকে আর কাজ নেই। ওদের কাছে গিয়ে দেখি ওদের কি অবস্থা। ওদের খুঁজতেও অনেকটা সময় লেগে গেলো। কি কান্ড! ওদেরও দেখি আমার মতো অবস্থা। কারো-ই বেশি বিক্রি হয়নি।আজ রহিম চাচা অনেক বকা দিবে।
” চল রহিম চাচার কাছে যাই।খাবিনা তোরা?”
আমার কথার উত্তরে মিনি বললো “ফুল বিক্রি হয় নাই চাচা খাইতেও দিবোনা”। ” আগে যাই ” এটা বলে আবার রহিম চাচার কাছে আসছিলাম । সবারই মন খারাপ।কই ভাবলাম আজ ভালো বিক্রি হবে আর দিনটা ভালো যাবে। কি থেকে কি হলো।
ফিরে আসার পথে একটা আপু ডাক দিলো। আপুটা দেখতে খুব সুন্দর। হাতে অনেক গুলো বাক্স। যেখান থেকে খাবারের গন্ধ বের হচ্ছিল।মনে মনে ভাবছিলাম আপু আমাদের খাবার দিবে হয়তো। আর হলোও তাই।খাবার দিয়ে আমাদের ফুলগুলোও কিনে নিয়ে গেলেন।এটা দেখে আমাদের খুশি দেখে কে! আমাদের সাথে কিছুক্ষণ থেকে আপু চলে গেলেন।
খাবারের গন্ধে ক্ষিদে দ্বিগুণ হয়ে গিয়েছে।সবাই মিলে রাস্তার ধারে বসে খাবার খেয়ে নিলাম।যাক বাবা বাচা গেলো। আজ আর বকা শুনতে হবে না।খাওয়াও হয়ে গেলো সাথে ফুলও বিক্রি হয়ে গেলো।
“আইজ আর কাম নাই।চল সবগুলা মিলে খেলি।” রাজুর কথায় সবাই রাজি হয়ে গেলাম।
শুরু হলো আমাদের খেলা। খেলতে খেলতে কখন সন্ধ্যা হয়ে গেলো টেরই পেলামনা। আজান দেয়ার সাথে সাথে সবাই রহিম চাচার কাছে হাজির। টাকা দেয়ার পর চাচা খুব খুশি। কারণ আজকের মতো সব ফুল কখনো বিক্রি হয়না। সব বিক্রি হওয়াতে চাচা আজ ভালোই খেতে দিয়েছেন।
এবার ঘুমানোর পালা। ইশ আজকের মতো প্রতিদিনই যদি এমন কাটতো।কতোই না ভালো হতো।কারো কথা শুনতে হতো না,কাজে ভুল হলে বকা শুনতে হতোনা,খাবারের জন্য কষ্ট করতে হতো না। কাল আবার সেই কাজ খোজা,সারাদিন কাজ করে ১ বেলা খাবার খাওয়া।যাক বাবা এতো ভেবে লাভ নেই। এখন ঘুমানোই ভালো।
পল্টু,বাবলু,রাজু,মিনির মতো পথশিশুদের সংখ্যা অনেক। এক গবেষণায় দেখা দিয়েছে বাংলাদেশে ১১-১২ লক্ষ পথশিশু রয়েছে। কিন্তু পল্টুর আজকের দিনের মতো সবার দিন ভালো যায়না।তাদের প্রতিদিন যুদ্ধ করে বেচে থাকতে হয়।তাদের পাশে দাঁড়ানোর মতো মানুষের অনেক অভাব।যদি তাদেরও সুযোগ সুবিধা দেয়া যেতো তবে তারাও দেশের অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা রাখতে পারতো।দরকার একটু সাহায্যের, একটু ভালোবাসার।আর পাঁচটা শিশুর মতো অধিকার নিয়ে বাচতে আসুন সকলে তাদের পাশে দাড়ানোর চেষ্টা করি।আমাদের একটি উদ্যোগ তাদের জীবনসংগ্রামকে অনেকটাই সহজ করে দিতে পারে।
লেখাটি নিয়ে মতামত