কেমন হতো যদি খুব বেশি হোমওয়ার্ক করতে না হতো? প্রায়ই দিতে হতো না বোর্ড পরীক্ষা? পড়ালেখা হতো মজায় মজায়? চতুর্থ শ্রেণিতে ওঠার আগ পর্যন্ত দিতে হতো না কোনো পরীক্ষাই?
এমনটাও কি হয় নাকি ! তাহলে তো পড়ালেখা গোল্লায় যাবে। প্রকৃতপক্ষে কিন্তু তা নয়। বরং এই ধরণের নিয়মগুলোকে কেন্দ্র করেই একাধারে ফিনল্যান্ড, নেদারল্যান্ড, জাপান, সুইজারল্যান্ড ইত্যাদি দেশগুলো কিন্তু শিক্ষা ব্যবস্থার শীর্ষে স্থান করে নিয়েছে।
নেদারল্যান্ডে শিশুদের ঘাড়ে এক বস্তা হোমওয়ার্ক চাপিয়ে দেওয়া হয় না, স্কুলের পড়া স্কুলেই শেষ করে তারা বাসায় ফিরে যায়। ১৬ বছর বয়সে গিয়ে মাত্র একটি বাধ্যতামূলক পরীক্ষায় অংশ নিতে হয় তাদের। নেদারল্যান্ডের শিক্ষা-ব্যবস্থা এমন যে সেখানকার শিক্ষার্থীরা বেশ সুখী জীবন কাটায়। জাপানে প্রি-স্কুলগামী শিশুদেরকে দেওয়া হয় বিশেষ যত্ন ও শিক্ষা। চতুর্থ শ্রেণিতে ওঠার আগ পর্যন্ত তাদের কোনো পরীক্ষা নেওয়া হয় না, নৈতিক শিক্ষা, প্রাণীদের যত্ন নেওয়া, প্রকৃতির প্রতি তাদের দায়িত্ব এসবই শেখানো হয় প্রি-স্কুলগামী শিশুদের।
একটি শিশু যখন এই পৃথিবীর আলো দেখে তখন থেকেই শুরু হয় তার শেখার যাত্রা। কিভাবে শিখতে হবে সেই শিক্ষাও তাকে দিতে হয়। জীবনের প্রথম শিক্ষাগুলো যেমনঃ খাওয়া, হাঁটা-চলা, কথা বলা ইত্যাদি একটি শিশু পরিবার থেকেই প্রথমে পেয়ে থাকে। পূর্বে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার হাতেখড়িও পরিবারেই শুরু হত। কিন্তু বর্তমানে অতিশয় ব্যস্ততার মাঝে তা সম্ভবপর হয়ে উঠে না। এজন্য শিক্ষার জন্য তাদেরকে খুব ছোট বয়সেই স্কুলে পাঠানো হয় যাকে বলা হয় প্রি-স্কুলিং।
প্রি স্কুলিং বা প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা বলতে বোঝায় ৩-৫ (সর্বোচ্চ ৬ বছর) বছর বয়সী শিশুদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বাধ্যতামূলক শিক্ষা শুরু করার আগের শিক্ষা অর্থাৎ প্লে, নার্সারি কিংবা কে.জি-তে (কিন্ডারগার্টেন) অধ্যয়ন। শিশুরা মাটির ছাঁচের মতো যাদেরকে যে কোনো ছাঁচে গড়ে তোলা যায়। আর মাটির ছাঁচকে সুন্দর রূপে গড়ে তুলতে যেমন কুমার প্রয়োজন তেমনই শিশুদেরকে গড়ে তুলতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কিংবা শিক্ষক প্রয়োজন। এখন মনে হতে পারে প্রি-স্কুলিং ছাড়াই যদি একটু শিশুকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেওয়া যায় তাহলে কি কি সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে? প্রি-স্কুলে একটি শিশু-
স্কুলে ভর্তি হওয়ার উপযোগী হয়ে গড়ে উঠে। অন্যান্য শিশু শিক্ষার্থীদের সান্নিধ্যে সামাজিকতার শিক্ষা লাভ করে যা বর্তমানে একক পরিবারে বেড়ে ওঠার জন্য সহজে সম্ভব হয় না। খেলাধুলার ছলে সেসব শিক্ষার্জন করে যা হয়ত বাসায় বসিয়ে শেখানো সম্ভব নয়। এছাড়া বর্তমানে খেলার মাঠ ও খেলার সঙ্গী উভয়ের অভাবেই শিশুরা খেলাধুলা থেকেও পিছিয়ে যাচ্ছে যা কাম্য নয়। কিন্তু প্রি-স্কুলে বাচ্চারা সেই সুযোগ পাচ্ছে।
নৈতিকতার ভিত্তি শৈশবেই তৈরি করতে হয়। শিশুরা এখানে যোগাযোগ শেখে, শেখে সহযোগিতা, সহানুভূতি , ঐক্য ও বন্ধুত্ব। এই বয়সেই শিক্ষার গোড়া মজবুত করতে প্রি-স্কুলিং জরুরী। এছাড়া দেখা যায় প্রি-স্কুলে যেভাবে শৃঙ্খলা বজায় রেখে শিশুদেরকে গুরুত্বের সাথে শিক্ষা দেওয়া হয়, বাসায় ততটা করা সম্ভব হয় না। যেসব শিশুরা প্রি-স্কুলিং করে স্কুলে ভর্তি হয় সেসব শিশুরা, সরাসরি স্কুলে ভর্তি হওয়া শিশুদের চেয়ে সকল কার্যক্রমে এগিয়ে থাকে।
এছাড়া প্রি-স্কুলিং নিয়ে উন্নত শিক্ষা ব্যবস্থায় তিনটি ধাপে পরিকল্পনা তৈরি করা হয়।
- দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা
- মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনা
- স্বল্পমেয়াদী পরিকল্পনা
বর্তমানে অভিভাবকরা শিশুদের শিক্ষা নিয়ে যথেষ্ট সচেতন। তাই প্রি-স্কুলিংয়ের উপযোগিতাও আগের তুলনায় বেড়েছে কয়েক গুন। বলতে হবে, জাতির মেরুদণ্ড বলে অভিহিত শিক্ষাই একটি জাতিকে দাঁড় করাতে পারে আবার শিক্ষার দুর্বল ভিত দুর্বল করে দিতে পারে গোটা দেশকেই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিবর্তন এনে মাত্র ৫০ বছরের মধ্যে গোটা দেশকে বিশ্বের সামনে দাঁড় করাতে সক্ষম হয়েছিল জাপান!
বর্তমানে আমাদের দেশেও প্রি-স্কুলিংকে বেশ জোর দেওয়া হচ্ছে। শুধুমাত্র ব্যক্তিগতভাবেই নয় সরকারি ভাবেও বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে যেন সকল শিক্ষার্থী সমান সুযোগ পায়। প্রি-স্কুলিং যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ সে বিষয়টি মাথায় রেখেই বাংলাদেশ সরকার ২০২১ সাল থেকে ৩য় শ্রেণি পর্যন্ত সকল পরীক্ষা বাতিল করেছেন যাতে করে শিক্ষার্থীদের ওপর চাপ কমে এবং তারা শিক্ষাকে উপভোগ করতে পারে।
প্রি-স্কুলিংয়ের ক্ষেত্রে আমাদের কিছু বিষয় মাথায় রাখতে হবে-
এইসময় শিশু যেন ভদ্রতা, সহমর্মিতা, বন্ধুত্ব, সময়ানুবর্তিতা, সততা, নিষ্ঠা, নিয়মানুবর্তিতা ইত্যাদি গুনাবলি অর্জন করতে পারে সে দিকটি লক্ষ্য রাখতে হবে। ছোট থেকেই একটি শিশু যদি এই বিষয়গুলো শিখতে থাকে তবেই সে একজন ভালো মানুষ হতে পারবে। এই বয়সে যদি শিশুকে উৎসাহ দেওয়া হয়, তার কাজের প্রশংসা করা হয়, তার ভুলগুলোও ইতিবাচকভাবে ধরিয়ে দেওয়া হয় তবে শিশুটি আত্মবিশ্বাসী এবং ইতিবাচক একজন মানুষ হিসেবে গড়ে উঠবে।
মনে রাখতে হবে শৈশবকাল হচ্ছে ভিত্তি। একজন মানুষ কতটা মানবিক বা সমাজের জন্য কতটা উপকারী তার অনেকটাই নির্ভর করে সে কেমন শৈশব পেয়েছে তার ওপর। তাই শৈশবকালকে দিতে হবে সর্বোচ্চ গুরুত্ব।
লেখাটি নিয়ে মতামত