কেউ যদি কখনো আমাকে জিজ্ঞেস করে আচ্ছা তোমার জীবনের সবথেকে সুন্দর সময় কোনটা? আমার হয়তো এটার জন্য ভাবতেই হবে না! নিঃসন্দেহে বলে দিতে পারব আমার কৈশোর সময়৷ হ্যা কৈশোর সময়! সবার ছোটবেলাটা সবথেকে প্রিয় হয় কিন্তু আমার ক্ষেত্রে কৈশোর সময়টাই ছিল সব থেকে সুন্দর। জীবনটা এমন একটা রুটিনে বাধা পড়ে গিয়েছিল যে সেখান থেকে নিজেকে বের করে অন্য রুটিনে আনতেও ভাল লাগতো না!
সকাল হত তখন ৫ টায়! রাত ১/২ টায় ঘুমিয়েও ভোরে উঠতে তেমন কষ্ট লাগতো না। সকাল থেকে সন্ধ্যা সময়টার চক্র ছিল টিউশন-স্কুল-টিউশন। ব্যাগ কাধে নিয়ে ছুটে চলা! তবুও কেমন একটা মজা কাজ করতো এসবের মধ্যেও। ক্লাসের ফাকে গতদিনের দেখা টিভিসিরিজ, সিরিয়াল আর ক্রিকেট -ফুটবলের গল্প করা! কে কতটুকু বলতে পারে সেটা! আজও মনে আছে একটা সিরিয়াল দেখার জন্য সারাদিন বই নিয়ে বসে থাকতাম! ২১ মিনিটের একটু ভাললাগার জন্য! পরের দিন সেটা নিয়ে আলোচনা করতে হবে তো৷
হিন্দি বলা, লিখতে শেখা যেন একটা শখে পরিণত হয়েছিল সে সময়। ছিলনা ফোন, ইউটিউব বা যান্ত্রিকতার ভীড় তবুও টিভি দেখেই শিখে নিতাম! হয়তো শেখার অদম্য ইচ্ছা ছিল তখন। তখন আমাদের চিন্তার একটাই কারণ ছিল যেটা পড়াশোনা! ১ মার্ক কম পেলে বাসায় মুখ কিভাবে দেখাবো!!!! বাবার সামনে রেজাল্ট কার্ড দেখানোতো ছিল আরো বড় আতঙ্ক! তখন মাইলের পর মাইল হাটলেও পা ব্যাথা করতো না।
এখনো মনে পড়ে সেই ভোর বেলায় টিউশন ছিল! পাশের বাসা থেকে বান্ধবী ডেকে ঘুম ভাঙ্গাত! একসাথে পড়তে যাওয়া সেই কনকনে ঠান্ডার মধ্যে! একদিন তো এক চোরকে আমাদের বাসার উপর বসে পা দোলাতে দেখে কি ভয়টাই না পেয়েছিল ও! ভুত বা পেত্নীই হয়তো ভেবেছিল! জ্বর এসেছিল কিনা ওর ঠিক মনে নেই!
টিউশন করে বাসায় ফিরতে দেরি হয়ে যাবে রাস্তায় একা! তখন দুই বান্ধবী এগিয়ে দিয়ে যেত হাফ রাস্তা! ঐ হাফ রাস্তা এসেও গল্পে মশগুল হয়ে পড়তাম। যেটাই খাই না কেন সেটাকে ৮/৯ টুকরো করেই খেতাম! একটা বাদাম হলেও! সারাদিনের সব কর্মকাণ্ড লিপিবদ্ধ হতো ডায়েরির পাতায়! বাবা মা বকা দিলে ডায়েরি লেখা, সিরিয়ালের নতুন কাউকে ভাল লাগলে লেখা! কিন্তু আজ সেই ডায়েরি গুলো খুলে দেখতেই লজ্জা লাগে! হাসি পায়! তাই সেগুলো আজ লুকিয়েই রাখতে ইচ্ছা করে! নিজের থেকেও!
আজ হটাৎ এক কিশোরী ছোটবোনের ডে দেখে এসব মনে পড়ে গেলো! যদিও আমাদের জীবন মোবাইল কেন্দ্রিক ছিল না কিন্তু অসম্ভব সুন্দর অবশ্যই ছিল! যেটা মনে পড়লেও মুখে একটা হাসির রেখা ফুটে ওঠে!
জানিনা হঠাৎ করেই আমরা যেন কেমন বড় হয়ে গেলাম! পরিচিত হলাম নতুন শব্দ ডিপ্রেশনের সাথে! আজ কৈশোর সময়ের যে বান্ধবীকেই দেখি তার মাথায় আছে চিন্তার পাহাড়! ফ্যামেলি প্রবলেম, পড়াশোনার টেনশন, জবের টেনশন, নিজের খরচ নিজে চালানোর টেনশন! সবাই ম্যাচিউরডতো হয়েই গেলো কিন্তু জীবনের সেই অসম্ভব সুন্দর সময়টা হারিয়ে গেলো। যে যার মতো ব্যাস্ত এখন! পেছনে ফিরে ভাবার সময়টাই এখন সময় সল্পতায় ভুগছে৷
মন খারাপ! ইউটিউব আছে তো! একটা দুইটা গান শুনে নেই ব্যাস শেষ! কিন্তু আগে তো মন খারাপটাই ছিলনা। এখন সবাই আজকের দিনটাকে ঠেলে পার করে ফেলতে চায় যেকোনো ভাবে কিন্তু তখন! প্রতিটা মুহুর্ত ছিল খুশির। ছুটির দিনে বাসায় বসে বোর হতাম ভাবতাম ইশ যদি টিউশনটা আজ অন্তত থাকতো! সবার সাথে দেখাতো হতো! আর এখন! সারাদিনই চার দেওয়ালের মধ্যে থাকতে ইচ্ছা করে। বাইরে যাওয়াটা বা কারো সাথে দেখা করাটা যেন একটা আতঙ্ক! আবার জামাকাপড় পাল্টাতে হবে! আবার এগুলা হবে! ওগুলো হবে! আজ থাক পড়ে হবে এসব। কতটা বদলে গেছে জীবন তাইনা!
এটাকেই হয়তো বলে বড় হয়ে যাওয়া! হুট করেই কেমন যেন বড় হয়ে গেলাম। আজ হয়তো কৈশোর সময়ের ৯০% ই নেই আমার জীবনে কিন্তু আছে এই সুন্দর মুহূর্তগুলোর স্মৃতি ! যেগুলো আসলেই অসম্ভব সুন্দর! ডায়েরিটা লিখে বন্ধ করে কানে হেডফোন আর হাতে মোবাইল নিয়ে শুতে চলে গেল নেহা।
বন্ধ ডায়েরিতে লেখা হয়ে থাকলো সেই সুন্দর নব্বই শতক। আজ হাজারো নেটওয়ার্কের তারের ভীরে যাকে খুঁজেই পাওয়া যাবে না৷ নেটওয়ার্ক যেমন জালের মত বিস্তৃত হয়ে আছে ছিটেফোঁটা সব জায়গায় তেমন সেই সুন্দর নব্বই শতক পড়ে আছে এই জালেই বাধা পড়ে কোনো এক কোনায়। এখন কার কৈশর আলাদা। এখন হাতে ডিএসএলআর না থাকলে তো মান সম্মানই থাকে না। ও মা! বাটন ফোন? তার হদিসই তো আর কিছুদিন পর মিলবে না। হাতে একটা স্মার্ট এন্ড্রয়েড বা আইফোন না থাকলে কি গ্লামার বাড়ে? এখন এই গ্লামারের নেশায় কেড়ে নিচ্ছে হাজার হাজার জীবন!
আচ্ছা চেষ্টা করলে কি সত্যিই আবার সেই স্মৃতিঘেরা শৈশব কৈশোর পাওয়া যাবে কি?
লেখাটি নিয়ে মতামত