অবহেলা,অযত্ন,অনিশ্চয়তা, অক্লান্ত পরিশ্রম, অসীম যন্ত্রণা, অমানবিকতা, অনাচার, অস্থিরতা, অভাব-অনটন, হয়রানি, ঠাট্টা-বিদ্রুপ এসকল শব্দগুলো যখন একটা মানুষের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে যায় তখন তার জীবনটা অপরিকল্পিত পথেই রয়ে যায়।
আমাদের সমাজের একটি আলাদা চিত্রই রয়েছে পথশিশুদের ঘিরে। দিনরাত তাদের চোখমুখে হাহাকারের এক অলৌকিক ছায়া বিদ্যমান থাকে। তাদের চাহনিটা বড়ই অদ্ভুত হয়। জীবনে সুখ বলতে কিছু নেই তাদের আবার তারাই সবচেয়ে সুখী।
আশ্চর্য কিছু মুহূর্ত তারা প্রতিনিয়ত পার করে যাচ্ছে হেসেখেলে। শত প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েও আজ নিশ্চুপ, নির্বাক তাদের চাহনি। কিন্তু সমাজের সাধারণ ঘরের মানুষগুলো বেশ অসাধারণ শিশুগুলোকে (পথশিশু) দেখলেই একটা হিংস্ররূপ ধারণ করে কেন সেটাই অজানা আমার! হাজারো শিশুর ঠাঁই রেলস্টেশন, বাস টার্মিনাল, স্টেডিয়ামগুলোর আশেপাশে। আর্থ-সামাজিক নানা টানাপড়েনে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া এই শিশুদের পরিচয় ‘পথশিশু’।
যখন যা ইচ্ছে তারা মনের সুখে করে যাচ্ছে, বাধা-বিপত্তি তাদের নিত্যদিনের সঙ্গী তাও কিছুতেই যেন দমিয়ে রাখা যায় না তাদের। তাদের কঠিন চাহনিটাই এক একটা প্রশ্নের জবাব! মাঝে মাঝে মনে হয় ছোট্ট এই ফুটফুটে বাচ্চাগুলো এতো যন্ত্রণা কিভাবে সহ্য করে ,তাদের কি কষ্ট হয় না? কেননা তাদের প্রথম পরিচয় তারাও আমার, আপনার মত রক্ত মাংসের মানুষ। তাদেরও মন আছে,ভালো লাগা খারাপ লাগা রয়েছে, আনন্দ-যন্ত্রণা, অনুতাপ রয়েছে।
আসলে, আমাদের মনুষ্যত্ব জাতিতে অনেক রূপ বিদ্যমান যার কারণে আমরা মানুষরাই বিভিন্ন সময় বিভিন্ন অবাস্তব রূপ ধারণ করে থাকি, বাচ্চাগুলোকে (পথশিশু) নিচু চোখে দেখি, তাদের কটুকথা শুনাতে দুইবার চিন্তা করি না আর এটাই ভুলে যাই এই বাচ্চাটা কিন্তু আপনার, আমার পরিবারের অন্যান্য বাচ্চার মতোই; শুধু মাত্র জন্মটা অন্য পরিবারে!
নির্দিষ্ট করে থাকার কোনো জায়গা নেই তাদের, যেখান কাত সেখানেই রাত এমন যদি হয় পরিস্থিতি তাহলে চিন্তা করুন তো তাদের জীবনটা কতটা অনিশ্চয়তার মধ্যে দিয়ে কাটে সারাক্ষণ। সময় তো নিজ মহিমায় চলে যাচ্ছে তবে পিছিয়ে যাচ্ছে হাজারো পথশিশু।
যেখানে মাথা গোজার নির্দিষ্ট স্থান নেই, খাবার কখন কোথায় কি খাবে সেটাই যখন অজানা তখন সু-শিক্ষার কথা কিভাবে চিন্তা করবে তারা? আর বিপরীত পাশের মানুষটা যখন অবুঝের মতো আচরণ করে তারই বা শিক্ষিত হয়ে লাভটা হলো কি? প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার কেউ নেই। আসলে কি আমাদের নিজেদের মনের চিন্তাভাবনা ঠিক করতে হবে, তাহলেই একমাত্র সব ঠিক হওয়া সম্ভব।
মুক্ত বাতাসের সিক্ত ছোঁয়ায় উজ্জীবিত হয় প্রতিটি মানুষ। প্রত্যেকদিন নতুন কিছুর খোঁজে সারাক্ষণ ঘুরে বেড়ায় মানুষ। নিজের পরিবারের শান্তির জন্য কত কি করে থাকে আর তাদের (পথশিশু) শান্তির কথা ভাবার কেউ নেই। সামান্য ইট পাথরের ঘরবাড়ির জন্য বড়াই করি আমরা। আজ আমি তাদের জায়গায় থাকলে আমার কি হত সেই চিন্তা না হয় বাদই দিলাম। ভালো ব্যবহার টুকু তারা আমাদের কাছে আশা করতে পারে না?
কিন্তু আমরা নিজেদের স্বার্থ দেখি সব ক্ষেত্রেই, নিজেদেরকে রাজকুমার বা রাজকুমারী ভেবে নিই এক সেকেন্ডেই, আর এটাই বাস্তবতা। প্রতিনিয়ত একটা শিশু(পথশিশু )ধ্বংসের পথে চলে যাচ্ছে সঠিক শিক্ষার অভাবে, কর্কশ ব্যবহারের কারণে, অবহেলার কারণে।
পাড়ার অন্যান্য ছেলেমেয়েদের সাথে তাদের খেলতে শিখাই না, একই মক্তবে গেলে তাদের স্থান হয় পেছনের দিকে, অসুস্থ হলে টাকার অভাবে হাসপাতালের বারান্দায় হয় যখন তাদের ঠাঁই, খাবারের অভাবে যখন আত্মচিৎকার শুনতে হয় সমাজের বিভিন্ন কোনায় কোনায় সেখানে স্কুলে যাওয়ার কথা না হয় বাদই দিলাম। সবসময় কোনো না কোনো কিছুর জন্য তারা থাকে সবার মনের নিকৃষ্ট স্থানে।ছোট ছোট বাচ্চাগুলোর দোষ কোথায় বলতে পারেন? জবাব নেই কারও কাছে।
আমরা তাদের আপন করার সুযোগ দিই দেখবেন আপনা-আপনি তারাই আমাদের আপন হয়ে যাবে, পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের মত হয়ে যাবে, তারাও সুশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে নিজে রোজগার করার উপায় খুঁজে পাবে। তবে সুযোগটা আমাদের দিতে হবে। সব কিছু থেকে কারণ ছাড়াই তাদের বঞ্চিত করার অভ্যাসটা আমাদের দূর করতে হবে। মনে রাখতে হবে আমরা সবাই “মানুষ”। সমাজ আমাদের সবার তাই সমাজে মাথা উঁচু করে বাঁচার অধিকারও সবার।
পরিস্থিতির শিকারে আজ কেউ ঘুমায় এসি রুমে আর কেউ ঘুমায় রেললাইনের ধারে, পার্থক্য শুধু এটাই! সমাজতান্ত্রিক দেশে অসামাজিক কার্যকলাপ একদমই মানায় না। অল্প সংখ্যক শিশুর মাঝেও যেন সুবিধাবঞ্চিত শিশুটির জায়গা নিশ্চিত হয় সেটা দেখবার পালা সমাজের সকলের।
বদলে যাই আমরা, বদলে যাবে সমাজ, মুক্তি পাবে পথশিশু পদবি পাওয়া শিশু-কিশোর!
Image: Daily Star
লেখাটি নিয়ে মতামত