এই ট্রল, মেমের প্রজন্ম এর জন্য আমার সত্যিই বড় আফসোস হয়। ওদের কাছে আনন্দ করার উপলক্ষ হয় কাউকে ব্যঙ্গ করা বা বন্ধুদের সঙ্গে বির্বিকিউ পার্টি করা, সেইসাথে যোগ হয়েছে নেশা জাতীয় দ্রব্য। আমাদের সাথে এই প্রজন্মের দূরত্ব মাত্র এক প্রজন্ম , তবুও আমাদের সাথে তাদের দৃশ্যমান এবং অদৃশ্যমান পার্থক্য বিস্তর। আমাদের পছন্দ ছিল যে কোন আনন্দে বা উৎসবে বন্ধু বান্ধবি, আত্মীয়স্বজন, পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে একসাথে মজা করা, খাওয়া দাওয়া করা।
বাসায় বেশি মানুষ হলে আবার সবাই মিলে রান্না করা হতো। প্রতিদিন বিকেলে আমরা পাড়ার মাঠে খেলতে বের হতাম, তখন তো সবার হাতে মোবাইল ছিল না, তাই মনের যতো কথা সব গল্প করতাম খেলার সাথীদের সাথে। কোন বিশেষ দিন ছাড়া আমাদের সময়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান (কনসার্ট তো আমাদের ছোট শহরে হতো না তখন) হতো না, যা হতো সেখানেও আমরা আমরাই গান, নাচ করতাম এখনকার মত এত দামী বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করা হতো না তখন। আমরা দেশিয় বাদ্যযন্ত্র দিয়েই যে মজা করতাম তা এখন কার দর্শক ও শ্রোতাদের মাঝে বিলীন।
শুধু কি তাই? সেই সময়ে আমাদের সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতো সব বয়সি ও সব স্তরের মানুষ। টাকা দিয়ে যে গানের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে হয়, তা জেনেছি এই ঢাকা শহরে এসে। আরে ভাই, বৈশাখি মেলা, রথের মেলার কথা তো বলিইনি। চারপাশে বাঁশির শব্দ, হাতে ছাপ দেওয়া, রঙিন বেলুন, মেলার খেলনা, খাবার আরও কত কী? সেইসাথে কখনো কখনো হুট করে দেখা হয়ে যেত কোন আত্মীয়দের সাথে দেখা হয়ে যেত। মেলায় গেলেই কী এক অদ্ভূত ভালো লাগত।
রমজান মাসে ইফতারের সময়ে আমাদের এই রকম ইফতার পার্টি হতো না, আমরা পাড়ার সবার বাসায় ইফতারি আদান প্রদান করতাম। পাশের বাড়ির খালা প্রতিদিন জিজ্ঞাসা করত রোজা রাখছি কিনা, সেই লজ্জাতেই তো ক্ষুধা সহ্য করে প্রথম রোজা রাখা শুরু করেছিলাম।
সবার সাথে সবার একটা ভালো বন্ধন ছিল তখন। পাড়ার মুরব্বিদের প্রতিও একটা ভয়, সম্মানবোধ কাজ করতো। তখন বুঝিনি কিন্তু এখন নিজেদের মনে হয় যে, তখন আমরা সামাজিক ছিলাম।
বর্তমান সময়ের এত যুবসমাজ, ছাত্রসমাজ, অমুক সমাজ, তমুক সমাজের চাপে, এই প্রজন্ম বুঝি সমাজচ্যুত হয়ে যাচ্ছে। কী সুবিশাল অট্টালিকায় মানুষ থাকে ৩/৪জন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হাজার হাজার বন্ধু, কিন্তু মনের না বলা কথা বুঝার মত বন্ধু হাতে গোনা বা নেই, সংযুক্ত টয়লেটসহ ঘরে নিজেকে দরজা বন্ধ করে রেখে এরা অনেকটা একা থাকতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। বড়দের প্রতি শ্রদ্ধা তো দূরেই থাক, বড়রাই এদের দেখে ভয়ে থাকে। বিষয়টি অনেকটা ওই ভদ্রলোকের জুতার বাড়ি লুকানোর মত আর কি।
আমার সত্যিই খুব আফসোস হয় এই নতুন প্রজন্মের জন্য। এদের ভিতরের মানুষের চিৎকার কেউ শুনতে পায় না, এমন-কি এরা নিজেরাও নয়। ওরা হতে চায় একরকম, চলে আরেক রকম, ওদের অন্তরের শান্তি মিলে না আর। ফলে, পারিবারিক অশান্তি, নেশা, অশ্লীল কাজে লিপ্ত।
যাদের নিঃশ্বাসে প্রতিনিয়ত অক্সিজেনের চেয়ে বেশি কার্বনডাইঅক্সাইড প্রবেশ করে, যারা শিক্ষার চেয়ে বেশি প্রতিযোগিতা নিয়ে চিন্তা করে, যারা মনস্তাত্বিকের চেয়ে বেশি জাগতিক চিন্তা করে, যারা ছোটবেলা থেকেই বিভিন্ন সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের সাথে পরিচিত হয় নিজেদের প্রতিরক্ষার জন্য; সেই প্রজন্মের কাছে তো পরিবার মানে একটা টাকার বাক্স আর উৎসব মানে একটা ট্রেন্ড হবেই।
কোথাও না কোথাও একটা ঘাটতি তো আছেই। সেটা খুঁজে বের করে সমাধান করা খুব জরুরি। কারণ, এই প্রজন্মই তো আগামী, এরাই আগামী বাংলাদেশ, আগামী বিশ্ব।
লেখাটি নিয়ে মতামত