পৃথিবীর আলো দেখার পর থেকেই একটি শিশু কথা শুনতে খুব পছন্দ করে।দাদি-নানিরা যখন পাশে বসে আড্ডায় মেতে ওঠে তখন বাচ্চাটি নির্বাক হয়ে কথা শুনতে থাকে যদিও তখন বোঝার কোনো ক্ষমতা রাখে না তবুও মনে হয় যেন সবটা আয়ত্ত করতে পারছে।
ছোটবেলায় গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুৎ চলে গেলে প্রায় সময় দাদা-দাদি, নানা-নানি, বাবা-মা পুকুর পাড়ে বসে বা উঠানে বসে বিভিন্ন ধরণের রুপকথার গল্প শোনাত আর সেই রুপকথার গল্প শুনে আমরা সেটা বুঝি আর না বুঝি খুব মজা পেতাম। তবে সেটার ভাবার্থগুলো কিন্তু অনেক গুরুত্বপূর্ণ ছিল যেটা ধীরে ধীরে আমরা বুঝতে পারি।
কথায় বলে “মানুষ দেখে বা পড়ে যতটা না শিখে বা মনে রাখতে পারে তার থেকে বেশি শুনে অনেকটা মনে রাখতে পারে।” আসলেই কিন্তু তাই নয় তবে যদি আমাদের বলার ধরণ ঠিক থাকে এবং বোঝানোর ক্ষমতা প্রবল হয় তাহলেই কেবল বাচ্চারা শুনে বেশকিছু কথা আয়ত্ত করতে পারে।
উদাহরণ দিতে গেলে নিজের পরিচয়, পরিবারের পরিচয়ের কথা নিতে পারেন। গল্পের ছলেই কিন্তু সুস্থ স্বাভাবিক শিশুটি সবটা শুনেই মনে রাখে আজীবন, অবশ্যই নির্ভর করে আপনি কিভাবে গল্পটি তৈরি করেছেন।
এছাড়া আরেকটা ব্যাপার হয় তা হলো আমরা কেউ কেউ সম্পূর্ণ গল্প সঠিকভাবে শুনাই-ই না।
আমি পরিচিত একটি উদাহরণই দিচ্ছি। ধরুন আপনি আপনার বাচ্চাকে “মিনা কার্টুন”-এর গল্প শোনাচ্ছেন। কার্টুনের একটা পর্বে ছিল খাবারের সময় তাদের মা ‘মিনাকে’ মেয়ে বলে একটি ডিমের অর্ধেক দিয়েছিল আর তার ভাই ‘রাজুকে’ ছেলে বলে একটি ডিম-ই দিয়েছিল। এতে করে আপনার বাচ্চার মনে কিন্তু ছেলেমেয়ে নিয়ে ভেদাভেদ তৈরি হওয়া শুরু করবে। যদি আপনার বাচ্চাটি মেয়ে হয় তাহলে নিজেকে সকল কাজ থেকে গুটিয়ে নেয়ার চেষ্টা করবে। ভাবতে শুরু করবে পরিবারে ছেলেদের অধিকার বেশি এবং আপনার বাচ্চাটি ছেলে হলে সে ভেবেই নিবে সব রাজত্ব ছেলেদের হাতে এবং এটাই বাস্তবতা !
অথচ এই কার্টুনের দ্বারাই কিন্তু বোঝানো হয়েছিল যে ছেলেমেয়ে কোনো ভেদাভেদ নেই, আমরা মানুষ এটাই হচ্ছে আমাদের প্রথম পরিচয়।তাই গল্প বলা বা বাচ্চাদের সাথে কথা বলার ধরণ এবং বিষয়বস্তু নির্বাচনেও সর্তক হতে হবে।
যে বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করা হবে সেটা যেন সম্পূর্ণ করা হয় পাশাপাশি শিক্ষণীয় হয় সেই ব্যাপারে লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন। পরিবার একটি শিশুর আচার-আচরণ শিক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। পরিবারের প্রতিটি মানুষকে দেখে শিশুরা বিভিন্ন কার্যক্রম নিজেদের মধ্যে নেওয়ার চেষ্টা করে এবং নিজেকে পরিবর্তন করে।
একটি নদীর চেয়ে সাগরের গভীরতা কিন্তু অনেক আর সাগরের থেকে মহাসাগরের গভীরতাও কয়েকগুন বেশি, ঠিক তেমনই একটি শিশুর মস্তিষ্কে কোনো কথা জমা রাখার গভীরতাটাও একজন মধ্যম বয়স বা বয়ষ্ক মানুষের চেয়ে বেশি।
শিশুদের কাছে আশ্চর্যজনক সত্যি একটা জিনিস হলো “গল্প” আপনি যদি বারবার একই গল্প বলেন শিশুটি ঠিক প্রথমবারের মতই মনোযোগ দিয়ে আপনার কথা শুনবে। তবে চেষ্টা করা উচিত সঠিক তথ্যের দ্বারা, ইতিবাচক কোনো গল্পের মাধ্যমে বাস্তবতা বুঝানো। এতে করে তাদের মাঝেও ব্যাপকভাবে পরিবর্তন দেখা দিতে শুরু করবে।
একটি ভালো গল্প একটি শিশুর মধ্যে যেমন অনেক ভালো ভালো গুন নিয়ে আসতে পারে, ঠিক তার বিপরীতটাও কিন্তু হতে পারে, শুধুমাত্র গল্প নির্বাচনে গাফিলতির মাধ্যমে।
শিশুরা গল্প শোনার মাধ্যমে নিত্যনতুন শব্দ শিখে থাকে। সেই শব্দের দ্বারা তারা খুব সহজেই কিছুটা কঠিন বাক্যও অনেকটা সহজেই তৈরি করতে পারে। কেননা গল্প আকারে যেকোনো কথা-ই শিশুরা অনায়াসে নিজেদের চর্চায় নিয়ে নিতে পারে এবং পছন্দও করে।
পাশাপাশি গল্প বলা কিন্তু শিশুদের কল্পনা শক্তিকেও অনেকটা বৃদ্ধি করে। যখন একটি বাচ্চা খুব আগ্রহ নিয়ে একটি কাহিনী শুনতে থাকে তখন সে গল্পে থাকা সকল চরিত্র নিয়ে কল্পনা করতে শুরু করে দেয় এভাবে কিন্তু তারা গল্প শুনতে শুনতে নিজে গল্প বলায় আগ্রহ প্রকাশ করে। এতে করে তার কথা বলায় সাবলীলতা চলে আসে।
আর কথা বলায় নিজের মধ্যে কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্ব না থাকলে সেই বাচ্চাটি কিন্তু খুব সহজেই বিভিন্ন বিষয়ে সুন্দরভাবে গুছিয়ে কথা বলাও শিখে যায় দ্রুত।আমরা একটি শিশুকে সেইসকল শিক্ষা দেওয়ার দায়িত্ব নিব যেটা তাদের পালন করা কর্তব্য হয়ে দাঁড়াবে।
এছাড়া আমরা প্রায়ই তাদের সামনে গল্পের আসর বসিয়ে দিই সমাজের বিভিন্ন অপকর্মের বিষয় নিয়ে বা পাশের বাসার পরিবারের ঝামেলা নিয়ে। এতে করে তারা সেসকল বিষয়গুলোতে খুব বাজে ভাবে প্রভাবিত হতে পারে। ভবিষ্যৎ জীবনে উজ্জ্বল নক্ষত্রগুলো বিনা কারণে অন্ধকারের মায়ায় জড়িয়ে যাবে।
একটি নিষ্পাপ শিশুকে তার নিষ্পাপ হাসি নিয়ে বাঁচতে শিখানোটাই বড়দের দায়িত্ব, সেটা গল্প বলার মাধ্যমেই হোক না কেন!!
লেখাটি নিয়ে মতামত