বন্দি জীবন জীবন্ত লাশের চেয়ে কম কিছু নয়। যে জীবনে স্বাধীনতা নেই, সেই জীবন যেন বেঁচেও মরে থাকার মতোই। সেটা মানুষ হোক বা জীবজন্তু! আমরা মানুষ বটে তবে কোনো প্রাণী বা জীবজন্তুর স্বাধীনতাকে হরণ করার কোনো অধিকার আমাদের আছে কি?
আমার তো অন্তত মনে হয় নেই! স্বাধীনতা না পাওয়ার যন্ত্রণা বাঙালিদের থেকে আর কারাই বা ভালো বুঝে! নিজের দেশকে স্বাধীন করতে তাদের প্রাণ পর্যন্তও দিতে হয়েছে অথচ তারাই এখন কেড়ে নিচ্ছে প্রাণীদের স্বাধীনতা! আলাদা করে দিচ্ছে নিজ পরিবেশ থেকে!
হ্যাঁ, আমি চিড়িখানার কথাই বলছি। চিড়িয়াখানা এমন একটি জায়গা বা স্থান যেখানে প্রাণীগুলোকে বন্দি করে রাখা হয় মানুষের দর্শনের জন্য, যেটা তাদের জন্য কেবল কিছুটা সময়ের বিনোদনের মাধ্যম! নিজেদের সুখ, আনন্দ,শান্তির জন্য আমরা চিড়িয়াখানার পক্ষে কোনো যুক্তি দেখাতে পারি না।
শুধুই কি খাঁচায় বন্দী করে রাখছি আমরা? সেটাও কিন্তু না। একে তো এদের বন্দি করে রাখা হয় তার ওপর আবার ঠিকভাবে ওদের যত্নও নেওয়া হয় না, খাওয়া-দাওয়ার কোনো সঠিক সময় থাকে না, পাশাপাশি প্রয়োজন অনুযায়ী খাদ্য তালিকাও নেই, নেই যথেষ্ট পরিমাণ খাদ্য। যেখানে বন্দি করে রাখা হচ্ছে সেই জায়গাটাও থাকে বেশিরভাগ সময় অপরিষ্কার। শেষ পরিণতি হয় কোনো কোনো প্রাণীর মৃত্যু দিয়ে, একই সাথে কিছু প্রাণীর বিলুপ্তিও ঘটে।
জেলখানা চিনেন তো সবাই তাই না?
সেখানে বন্দি করার জন্য গাড়ি করে নিয়ে যাওয়া মানুষগুলোকে আশা করি দেখেছেন। তো মানুষগুলোর মুখের হাহাকারটাও নিশ্চয়ই দেখেছেন। তখন আমরা কেউ কেউ মাঝে মাঝেই বলি কেন দোষ করতে গেল বা খারাপ কাজের সাথে জড়িয়ে গেল কিন্তু এই আমরাই এমন গাড়িতে করে পশুপাখি, জীবজন্তগুলোকে নিয়ে যাই চিড়িয়াখানায় বন্দি করার জন্য। ওদের কিন্তু কোনো দোষও নেই, উদ্দেশ্য একটাই- মানুষের বিনোদন ও জানার পরিধি বৃদ্ধি করা। আমার কথা হলো তখন কোথায় থাকে আমাদের দরদ,কোথায় থাকে মনুষ্যত্ববোধ! মানুষের মানবিকতা আজ কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে, একবার ভাবুন এবং নিজেদের মনকে প্রশ্ন করুন, উত্তর পেতে খুব বেশি সময় লাগবে বলে মনে হচ্ছে না!
আত্মতৃপ্তি যদি মানুষের প্রশান্তির কারণ হয় তাহলে পশুপাখি, জীবজন্তুর আত্মতৃপ্তিকে আমরা কেন সম্মান দিতে পারছি না, কেন ছিনিয়ে নিচ্ছি? শুধুই কি আমাদের নিজেদের ভালো লাগার জন্য? এতে করে মানুষ যে স্বার্থপর সেটার প্রমাণ দেওয়া হয়ে গেল না? একটু চিন্তা করুন তো!
চিড়িয়াখানা- শুধু যে বাইরের পরিবেশে বেশ বড় করে আলাদা আলাদা খাঁচায় পশু-পাখিকে বন্দি করে রাখা হয় তা কিন্তু নয়। কেননা আমরা আমাদের নিজেদের বাসায়ও নিজেদের পছন্দমতো পাখি, জীবজন্তু পুষে থাকি,অ্যাকুরিয়ামে মাছ বন্দি করি । এটাও কিন্তু ঠিক হচ্ছে না কারণ বাইরের দিকটা দেখলাম অথচ সেই আমরাই আবার পশু-পাখিগুলোকে ঘরবন্দি করে রাখলাম সেটা তো ঠিক হলো না। বাহিরের যুদ্ধের কোনো মানেই রইল না তবে। ঘরে বাইরে সমান তালে তাল মিলিয়ে চলতে পছন্দ করা মানুষটা যেন আসলেই দুইদিকে এক পক্ষের হয় সেই মনমানসিকতা গড়ে তুলতে হবে নিজেদের মধ্যে।
প্রাণীদের আবাসস্থল বন-জঙ্গল, সেক্ষেত্রে তাদের ধরে বেঁধে খাঁচায় বন্দি করা, একটা প্রাণীকে বংশচ্যুত করা, জীবজন্তুর ওপর অনাচার-অত্যাচার সত্যিই খুব অন্যায়। আপনি নিজে চিন্তা করুন তো আপনাকে যদি হঠাৎ করেই ধরে বেঁধে আপনার পরিবেশ থেকে নিয়ে একটা জঙ্গলে রেখে আসা হয় আপনি কতটুকু শান্তিতে বসবাস করতে পারবেন? টিকে থাকতে পারবেন কি? লম্বা সময়ের জন্য টিকে থাকা অসম্ভব। কারণ সেই পরিবেশ আপনার জন্য না।
মাছ বসবাস করে পানিতে, পাখিরা বিভিন্ন গাছে নিজ বাসা বেঁধে থাকে, গরু থাকে গোয়ালে, জীবজন্তু বন-জঙ্গলে থাকতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে আর মানুষ থাকে সুস্থ স্বাভাবিক সমাজে অর্থাৎ যাদের জন্য যে পরিবেশ তারা সেই পরিবেশেই অভ্যস্ত। আসলে কি জানেন, নিজের সাথে যেকোনো কিছুর তুলনা করলেই বিপরীত পাশের দুঃখ, কষ্ট, সুখ, আনন্দের অস্তিত্ব নিঃসন্দেহে উপলব্ধি করা যায়! করোনা পরিস্থিতি আরও আমাদের ঘরবন্দী অবস্থা উপলব্ধি করতে সাহায্য করছে।
অবশ্যই ছোট-বড় সকলের জীবজন্ত, পশুপাখি সম্বন্ধে জ্ঞান থাকা প্রয়োজন তবে আমাদের সেই চাহিদা মেটানোর জন্য আমরা চিড়িয়াখানা ব্যবহার করতে পারি না। প্রয়োজনে গাজীপুর এবং কক্সবাজারে অবস্থিত সাফারি পার্কের মতো সকল চিড়িয়াখানার ব্যবস্থা করা যেতে পারে, যেখানকার চিত্রটাই ভিন্ন।সাফারি পার্কের দৃশ্য চিড়িয়াখানার বিপরীত। কিছু সময়ের জন্য আমরা থাকি খাঁচার (গাড়িতে) ভিতরে আর যাদের রাজ্য পরিদর্শনে আমরা যাই তারা তাদের মতো রাজত্ব করে নিজ মহিমায়। আসলে তো এমনটাই হওয়া উচিত, যে যার রাজ্যে রাজ্যত্ব করার কথা। সাফারি পার্ক তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত উদাহরণ!
আমি ও আমার মতো হয়ত আরও অনেকেই স্বপ্ন দেখে যে, চিড়িয়াখানায় অযত্নে বন্দি থাকা প্রাণীগুলো একদিন ঠিকই ছাড়া পাবে মানুষরূপী কিছু প্রাণীর হাত থেকে। সেইদিন জীবজন্তুগুলো খোলা আকাশের নিচে আপন মনে ঘুরে বেড়াবে, স্বাধীনভাবে চলাফেরার আনন্দ উপলব্ধি করতে পারবে, যত্নের স্বাদ নিবে নিজ দলের প্রাণীগুলো থেকে।
মানুষের সামান্য বিনোদন যেন কারও স্বাধীনতা হরণ না করে। এটা মানুষ হিসেবে প্রতিটি প্রাণীর প্রতি আমাদের দায়িত্ব এবং কর্তব্য। আমাদের কিছু পদক্ষেপই পারে প্রাণীগুলোকে নিজ পরিবেশে নিজের মতো করে টিকে থাকতে দিতে।
মনুষ্য জাতির আত্মতৃপ্তি ও বিনোদনের জন্য যেন প্রাণীকুল হারিয়ে না যায়। কোনো প্রাণীর চোখের পাতা ভিজে যাওয়ার কারণ যেন মানুষের বিনোদন না হয়, আর যেন না হয় তাদের স্বাধীনতা হরণ।
লেখাটি নিয়ে মতামত