আমি যদি ঘুড়ি হতাম আকাশের বুকে ঘুরে ঘুরে বেড়াতাম ,আমি যদি পাখি হতাম মুক্ত মেঘের সাথে ভেসে যেতাম-এসকল কাল্পনিক কথা আমরা প্রায় সময়-ই চিন্তা করে থাকি কিন্তু সাথে সাথেই উপলব্ধি করি যে এসকল চিন্তাই আমাদের জল্পনা কল্পনাতে বাসা বেঁধেছে, আমাদের আঁকড়ে ধরেছে নিজ মহিমায়।
ছেলেবেলার সেই ভাবনাগুলোতে মা যদি বলত, পাখি না হয়ে তুমি যদি হও পাইলট তাহলেই তো স্বপ্নপূরণ হয় তোমার। তুমি বদ্ধ থেকেও মেঘের ভেলায় ভেসে যেতে পারো, ঘুড়ি না হয়েও আকাশের কাছাকাছি যেতে পারো, আকাশ তোমায় আপন করে নেবে। এছাড়া ঘটনাটা এমন না হয়ে এটাও হতে পারত যে রোজ তিন চাকার বাহনকে আপন না করে দুই চাকার সাইকেলকে আপন করার স্বপ্ন দেখাত বাবা।
আমাদের শৈশবের স্বপ্নগুলো সত্যি বড় অদ্ভুত। নিজ ইচ্ছেকে প্রাধান্য দিতে আমরা প্রায় ভুলেই যাই। পাশাপাশি অন্যের ইচ্ছেগুলোকে নিয়ে মাতামাতি করার ইচ্ছেটাও যেন বরাবরের মত থেকে যায়। শিশুকিশোর বয়সে এসেও আমরা মনে করি রোজ সকালে পায়ের উপর পা রেখে একটা খবরের কাগজ হাতে নিয়ে চায়ের কাপে চুমুক না দিলে যেন ভালো দিন কাটানো যায় না,ভোর বেলা জোরে জোরে শব্দ করে না পড়লে যেন ভালো ছাত্র হওয়া যায় না। ডাক্তার,ইঞ্জিনিয়ার না হলে যেন কোনো চাকরিতেই ভালো মাইনে পাওয়া যায় না। এসকল চিন্তাভাবনাগুলোর জন্যই আমরা আমাদের ইচ্ছেকে নিজ পথে ধরে রাখতে পারি না। ইচ্ছেগুলো লাইনচ্যুত হয়ে ভেসে যায় পথ হারাবার দেশে।
কেন আমরা নিজের মধ্যে কাল্পনিক স্বপ্নগুলোকে বাসা বুনতে বাধা দেই? কেন আমরা ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্নকেই শুধু নিজেদের মধ্যে না নিয়ে ভালো মানুষ হওয়ার প্রতিজ্ঞা করি না? কেন সাধারণ হয়েও আমরা নিজেদের মধ্যে অসাধারণত্বের ছোঁয়া থেকে দূরে সরে যাই না ! কারণ একটাই! আমরা নিজেদের ইচ্ছেকে নিজের মধ্যে না নিয়ে অপরের স্বপ্নপূরণে নিজের জীবন উৎসর্গ করে দিই। নিজের সুপ্ত স্বপ্নকে এবার ডানা মেলতে দেওয়ার সুযোগের পালা চলে এসেছে।শিশুকিশোররা হার মেনে নিতে শিখে না, নিজের সর্বোচ্চটুকু দিয়ে অন্যের মতামতকে নিজের স্বপ্নের মধ্যে হস্তক্ষেপ করতে না দেওয়ার পালাও এবার এলো বলে!
ছোটবেলা থেকেই মা-বাবার স্বপ্ন পূরণে ব্যস্ত আমরা। নিজে কোন বিষয়কে নিজের মধ্যে নিতে পারব সেটা দেখার সময়টুকুও আমাদের দেওয়া হয় না।।নিজের স্বপ্ন পূরণ কথাটা না হয়ে তখন হয়ে যায় মা-বাবার স্বপ্ন পূরণ। অবশ্যই সেটা মন্দের কিছু নয় তবে নিজের চাওয়ার গুরুত্বটাও কিন্তু মন্দের দিকে পড়ে না। তবে বাবা-মা দায়িত্ব নিয়ে একটা শিশুকে খোলা আকাশের নিচে আপন মনে মাঠে খেলতে দেওয়ার একটা সুযোগ তো দিতেই পারে !
রবীঠাকুরের “ওগো আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে” কবিতার এই লাইনটি অর্থ অবস্থাভেদে এক এক রকম তবে এটাই যেন নিজ স্বপ্নে বাধা হয়ে না দাঁড়ায় সেটাও সকল বাবা-মার কর্তব্য বলে আশা রাখা যায়। একজন পর্বতারোহী হতে চাওয়াটা যেমন দুঃস্বপ্নের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত নয় তেমন একজন ক্রিমিনাল হতে চাওয়ার ইচ্ছেটাও গ্রহণযোগ্য নয়।তবে আমাকে ভেদাভেদটা নির্ণয় করা জানতে হবে।
যখন আমরা প্রথম প্রথম স্লেটে লেখার জন্য চক হাতে নিই বা খাতায় লিখার জন্য পেন্সিল হাতে নেই তখন অক্ষর লেখা শিখার আগে অনেক হাবিজাবি আঁকাআঁকি করি। তখন স্বভাবতই শোনা যায় ” দাগাতে দাগাতেই লেখা শিখবে।” এটা যদি সত্যি হয় তাহলে একটা বাচ্চা নিজ স্বপ্নে অটুট থাকার যোগ্যতাও রাখে। কারণ মাঝ পথে প্রতিকূলতা না এলে সফলতার স্বাদ নেওয়া যায় না ! নিজের ক্যারিয়ার গঠনের স্বপ্ন এমন একটা জিনিস যেটা শিশু থেকে শুরু করে একজন বৃদ্ধাও দেখে থাকে। হয়ত একটি শিশু তার স্বপ্ন বোনার প্রথম ধাপের জন্য সুতার খোঁজে থাকে আর একজন বৃদ্ধ তার স্বপ্ন বোনার শেষ ধাপটা পূরণ করার জন্য লড়াই করে, পার্থক্য এতটুকুই!
একটা উদাহরণ দিতে খুব ইচ্ছে করছে আর সেটা হলো- ধরুন একটা নাটাই।কখনো সেই নাটাইয়ে কালো সুতা আবার কখনো একই নাটাইয়ে সাদা সুতা তবে সুতা যাই হোক না কেনো নাটাই ঠিক রেখে আপনি যদি ঘুড়ি উড়াতে জানেন তাহলে দিনশেষে ভোকাট্টা আপনি বলতেই পারবেন-ই। ঠিক তেমনি,আমাদের ইচ্ছেপূরণের উদ্দেশ্য ঠিক রেখে আমরা ধাপে ধাপে এগিয়ে যেতে থাকলে লক্ষ্যে পৌঁছে ঘুড়ি কাটার পরে ভোকাট্টা বলে ঘুড়ির মতো আপন মনে আকাশে জায়গা করে নিতে পারবেন-ই। সুতরাং নিজ ইচ্ছেকে নিজের মধ্যে বাঁচিয়ে রাখতে শিখুন।
শিশু-কিশোরকাল থেকেই নিজের লুকায়িত ভালো স্বপ্নকে সবার মাঝে উপস্থাপন করতে না জানলে চিরজীবন সেটা লুকায়িতই রয়ে যাবে। বিশ্বাস করুন আর না-ই বা করুন কিন্তু কেউ আসবে না আপনার মধ্য থেকে টেনে আপনার ইচ্ছেকে পূরণ করতে বরং নিজের সুপ্ত প্রতিভাকে কাজে লাগাতে শিখুন কারণ প্রতিটু মানুষের নিজস্ব সত্তা রয়েছে যেটা আপনার স্বপ্নপূরণে সহায়ক হবে।
নিজের সুপ্ত ইচ্ছেকে ডানা মেলবার সুযোগ দিন, ইচ্ছে ঠিক একদিন আকাশে জায়গা করে নিবেই, নিবে !
লেখাটি নিয়ে মতামত