কারো কাছে গড অব ক্রিকেট, লেগস্পিনার আবদুল কাদিরের কাছে আবার দুধ পি তা বাচ্চা! ৪৭ পেরিয়েও যাকে সবাই ক্রিকেটের বিস্ময় বালক বলেন। ছেলে অর্জুনও ক্রিকেটের মাঠ দাপাচ্ছে। কিন্তু তাঁকে নিয়ে কাটেনি একটুও। ওয়াংখেড়ে বা ব্রাবোর্ন স্টেডিয়ামে কান পাতলে এখনো শোনা যায় ‘ শচীন, শচীন…. “। এতক্ষণে আপনার কানেও বাজতে শুরু করে দিয়েছে।
হেডেন বলতেন, আমি গডকে দেখেছি ভারতের হয়ে চার নাম্বারে ব্যাট করেন। শেন ওয়ার্ন তো নিজের আত্মজীবনীতেই লিখেছেন, তাঁর দুঃস্বপ্ন একটাই। তিনি ঘুমের মধ্যে শচীনকে বল করছেন আর বল আঁচড়ে পড়ছে গ্যালারীতে।
ওয়াসিমের বলে তাঁর ক্যাচ ফেলে দিয়েছিলেন রাজ্জাক। ওয়াসিম নিজেই বলেছেন, ম্যাচ তো ওখানেই শেষ হয়ে গিয়েছিল। ( ২০০৩ বিশ্বকাপে) । ৭৫ বলে করলেন ৯৮ রান। শারজাহ কাপে ‘ ডেজার্ট স্টর্মের ‘ সেই ১৪৩ রানের পরে যেটি শচীনের সবচেয়ে বিধ্বংসী ইনিংস।
তবে শচীনকে ১০০ টা সেঞ্চুরি, ওয়ানডের প্রথম ডাবল সেঞ্চুরি, এসব দিয়ে কেউ খুব একটা মাপে না। মাপা যায় না শচীনকে এসবে।
গ্যালারী ভর্তি দর্শক, দুই হাতে দুই বোতল, বোতলে দুইটা করে বাড়ি, আর মুখে সেই ক্রিকেটীয় জাতীয় সংগীত ‘ শচীন, শচীন…. ‘। ক্রিকেটে এরচেয়ে সুন্দর দৃশ্য নেই, নেই, নেই।
স্কুল ক্রিকেটে বিনোদ কাম্বলীর সাথে সেই জুটিতে কেড়েছিলেন নজর। ৬৬৪ রান হেসে খেলে করেছিলেন দুই হরিহর বন্ধু। অথচ, ১৬ বছর ২৮৯ দিন বয়সেই নেমে গিয়েছিলেন আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলতে। মুখ থেকে তখনো বেবী ফ্যাটের ছোঁয়াটা যায়নি। আবদুল কাদির এক ম্যাচে বলে বসেছিলেন, দুধের বাচ্চা। অবশ্য কাদিরের এক ওভারে ২৮ নিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, ‘ দুধ না খেলে, হবে না ভালো ছেলে ‘। পরে কাদিরের শিষ্য শেন ওয়ার্নের জন্য হয়ে গিয়েছিলেন আতঙ্কের নাম। গুরু বা শিষ্য, বেদম পেটানোর সময় এসব দিকে থোড়াই খেয়াল থাকতো শচীনের।
ব্রেটলি কি আর সাধে বলেন, যখন আপনি দ্রাবিড়কে আউট করবেন, সেটা অসাধারণ, যখন লক্ষ্মণকে আউট করবেন সেটা গ্রেট, কিন্তু শচীনকে যখন আউট করবেন, ওটা আসলে মিরাকল।
ম্যাকগ্রা -শচীন, শচীন -ওয়ার্ন, শচীন -ওয়াসিম এমন অনেক দ্বৈরথের সাক্ষী ক্রিকেট বিশ্ব। ব্যাটে যেটা ছিলো ক্যারিবিয়ান যুবরাজ ব্রায়ান চার্লস লারার সাথে। তবে ক্রিকেটে যদি জনতা জনার্দন মানে দর্শকই সব হয়ে থাকে, শচীনের মত করে কেউ পারেননি দর্শকের মন জিততে। ওয়াসিমের ফ্লাইট সুইং তো শচীনের স্ট্রেইট ড্রাইভ, ওয়ার্নের দুসরা, সমস্যা নেই – শচীনের এক্সট্রা কাভার আছে কি করতে। লারার ৪০০, তো শচীনের সেঞ্চুরির সেঞ্চুরি তো আর হাওয়ায় আসেনি।
২৪ বছরের ক্যারিয়ার! মানে দুই যুগ। জীবনের শেষ টেস্টে কাপা গলায় যখন বলছিলেন, ২২ গজে আমার ২৪ বছরের ক্যারিয়ার শেষ হয়ে আসলো, তখন বুঝাই যাচ্ছিলো ক্রিকেট কতটা আপন শচীনের। ২৪ বছর শচীনে বুঁদ হয়ে থাকা একটা প্রজন্ম বুঝতেই পারছিলো না, শচীন ছাড়া আবার ক্রিকেট কেমনে হয়? দ্বৈরথের সঙ্গী-সারথীরা প্যাডস -গ্লাভস -বল সব জমা দিয়ে দিয়েছেন ততদিনে। তারপরও ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামের বাইরে পানিপুরি ওয়ালাটাও বলেন, ‘ হাম পানিপুরি বেচেঙ্গে, পার উসমে আলু নেহি হ্যায় তু ভো ক্যায়সা পানিপুরি হ্যায়। শচীন আর ক্রিকেট ১৯৮৯ থেকে ২০১৩ এই সময়টাতে আসলে সমার্থক বনে গিয়েছিলো। ‘ আরে ভাই শচীন আয়া ‘ ক্রিকেটের অলিখিত বিজ্ঞাপন। ইডেন থেকে উইজডেন, ওয়াংখেড়ে থেকে ওয়ান্ডারার্স ; ২২ গজের ইঞ্চি ইঞ্চি তখন জানে শচীনের পা তো এই তল্লাটে পড়বে না।
আইপিএলের ঝনঝনানিতে সবাই যখন বুঁদ, অনেকেরই ধারণা ছিলো শচীন হয়তো ঠিক ওই জগতের প্লেয়ার নন। তবে ঠিকই দেখিয়েছেন মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সের হয়ে এক সিজনে সবচেয়ে বেশী রান করে। এমনকি সেঞ্চুরিও বাদ যায়নি।
টীম ইন্ডিয়ার জন্য কেমন প্রাণভোমরা ছিলেন সেটা ২০১১ বিশ্বকাপের টীম ইন্ডিয়ার দিকে তাকালেই বুঝা যাবে। সেবার ইন্ডিয়া শুধু ২৮ বছরের গেরো কাটায়নি কেবল, শচীনের হাতেও তুলে দিয়েছে আরাধ্য বিশ্বকাপ। টিম ইন্ডিয়ার প্রতিটা প্লেয়ার মুখেই সেবার অণুরণিত হয়েছিলো আমরা শচীনের জন্য বিশ্বকাপ জিততে চাই। ২০০৩ সালে যে ক্যাঙ্গারুদের কাছ থেকে খালি হাতে ফিরতে হয়েছে একবার।
‘৯৯ বিশ্বকাপ চলাকালীন শচীনের বাবা মারা যান। শেষকৃত্যে যোগ দিতে শচীন ইংল্যান্ড থেকে ভারতে উড়ে আসেন। যদিও ফিরে গিয়ে পরের ম্যাচেই সেঞ্চুরি করেছিলেন। টীম ইন্ডিয়া যেমন শুধু তাঁর জন্যই বিশ্বকাপ জিততে চেয়েছে, তেমনি শচীনও সবসময় নিজের দলের প্রতি এভাবেই নিবেদিত ছিলেন।
১৬ বছরে শুরু হয়ে প্রায় ৪০ এর কোটায় এসে ৭৪ রানের ইনিংসে যবনিকা ঘটে এক অনন্য ক্যারিয়ারের। ক্রিকেট অনেক আবেগঘন মুহুর্তের জন্ম দিয়েছে, অনেক আনন্দ বেদনার সাক্ষী ক্রিকেট। হোক ক্রিকেটার বা ক্রিকেটপ্রেমী ; সবার কাছেই মুহুর্তগুলোর এক অনন্য অর্থ আছে।
একজন পাঠক হিসেবে যদি আপনাকে বলি, ক্রিকেটে সবচেয়ে আনন্দঘণ মুহুর্ত কোনটি? বলুন দেখি! বলুন! বলুন না। পারছেন না?‘ শেষবারের মত শচীন পিচ কে ছুঁয়ে প্রণাম করতে আসছেন, ছুঁয়ে বিড়বিড় করে কি যেন বললেন, তারপর চোখ মুছতে মুছতে হাঁটা দিলেন ‘।
পেয়ে গেলেন না সবচেয়ে বড় ক্রিকেটীয় মুহুর্ত!
জার্সি নম্বর টেন, সাইন আউট ফ্রম ক্রিকেট, ফর ওয়ান্স এন্ড অল।
লেখাটি নিয়ে মতামত