একটা সময়ে বিকেল হলেই খেলার ধুম পড়ে যেত গ্রামের বাড়িগুলোর উঠানে উঠানে। চোখে কাপড় পড়িয়ে দিয়ে, আলতো করে তাকে ঘুরিয়ে দিয়ে শুরু হতো-কানামাছি ভোঁ ভোঁ-যাকে পাবি তাকে ছোঁ! অথবা অন্য যেকোনো খেলা যার জন্য পাড়ার ছেলে-মেয়েরা এক হয়ে যেত এক মুহুর্তেই। সন্ধ্যে নামলেই আবার ঘরে ফেরার ডাক পড়ত, কিন্তু কে শোনে কার কথা! মুরগীর লড়াই দেখা যে এখনও বাকি, লুকোচুরি খেলছি তো খেলছি, এখনও টুকুকে খুঁজে পাওয়া বাকি, একবার ওকে খুঁজি তবে যাব বাড়ি।
কিন্তু বর্তমান প্রকৃতি ভিন্নরূপ ধারণ করেছে। কালের পরিক্রমায় এদেশের ঐতিহ্যবাহী লোকজ খেলাগুলো বিলুপ্তির খাতায় নাম লিখিয়েছে, কোনো কোনোটা আবার বিলুপ্ত হয়েও গিয়েছে। গোল্লাছুট, দাঁড়িয়াবান্ধা, বৌছি, কুমির-ডাঙা, বরফপানি, ফুলটোকা, লাটিম খেলা, কুতকুত, মোরগ লড়াই, ষাঁড়ের লড়াই, ইচিং বিচিং, এলাটিং বেলাটিং, নৌকাবাইচ, ঘুড়ি ওড়ানো, কানামাছি, পুতুল খেলা, কাবাডি, চড়ুইভাতি, ব্যাঙের বিয়ে, লুডু, ডাঙুলি ইত্যাদি খেলা ছিল জনপ্রিয় লোকজ খেলা। কোনো কোনোটার জনপ্রিয়তা হয়ত এখনও আছে তবে পূর্বের মতো অতটা নয়। এসব খেলার নাম এখন যেন জাদুঘরের মতো শুধুই বইয়ের পাতায় সাজিয়ে রাখা হয়েছে।
প্রযুক্তির আশীর্বাদে দেশ যেমন একদিকে এগিয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে তেমনই হারিয়ে যাচ্ছে দেশের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি। আগে যেখানে কারেন্ট চলে গেলে উঠানে কুপি অথবা হারিকেন জ্বালিয়ে সকলে মিলে লুডু খেলতে বসে যেত, এখন সেখানে স্মার্ট ফোনে লুডু অ্যাপ নামিয়ে লুডু খেলতে বসে আধুনিক ছেলে-মেয়েরা। শহরে নেই পর্যাপ্ত খেলার মাঠ, গ্রামেও আগের মতো উঠানের ব্যাপকতা নেই। খেলার মাঠহীন স্কুল-কলেজ যেন প্রাণহীন দেহের মতো। কারণ শিশুদের প্রাণের বিকাশ ঘটে খেলাধুলার মাধ্যমেই। কিন্তু এখনকার বেশিরভাগ স্কুল-কলেজই একটি বিল্ডিংয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ।
“তাই বলতে হবে ছেলে-মেয়েদের খেলাধুলা করাটাই যেখানে অমাবশ্যার চাঁদ হয়ে গিয়েছে সেখানে খেলার নাম খুঁজতে যাওয়াটা নিছকই বোকামি”
গ্রামীণ খেলাধুলাগুলোর বৈশিষ্ট্য এমন যে ছেলে-মেয়েরা যদি খেলতে চায় তাহলে একে অপরের সাথে ভাব বিনিময় করাই লাগবে, অভিমান যদিও বা একটুখানি হয়েই যায় তবুও কানামাছি কিংবা লুকোচুরি খেলতে গেলে সেই অভিমান কিন্তু কাটিয়ে ফেলতে হবে কিংবা সাত পাতা খেলতে তো এক হতে হবে সবাইকেই।
খেলাধুলা যেমন মনকে প্রশান্তি দেয়, তেমনই এর মাধ্যমে উপহারস্বরূপ পাওয়া যায় সুস্থ দেহ, সক্রিয় মস্তিষ্ক, সহমর্মিতা, সহযোগিতা, অসাম্প্রদায়িকতা, হারকে মেনে নেওয়ার ক্ষমতা অর্জন, ঐক্য, বন্ধুত্ব ও একটি পূর্ণ শৈশব যা কিনা স্মার্টফোনের কোনো খেলার মাধ্যমে সম্ভব নয়।
“খেলতে গিয়ে যদি গায়ে, মুখে ও জামায় ধুলো না লাগে তবে আমার মতে সেই খেলা খেলাই নয়!”
শুধু যে প্রযুক্তি ও খেলার মাঠের স্বল্পতাই গ্রামীণ খেলাধুলাগুলোর প্রাণ কেড়ে নিয়েছে তা কিন্তু নয়, একই সাথে বিদেশি খেলাগুলোর আধিপত্যও একটি বিশাল কারণ। ফুটবল, ক্রিকেট, ব্যাডমিন্টন ইত্যাদি বিদেশি খেলাগুলোর ঝোঁকে প্রাণ হারাচ্ছে আমাদের জাতীয় খেলা হা-ডু-ডু বা কাবাডিও।
বর্তমানে আরেকটি চিত্র দেখা যায়। তা হলো শিশুদের কাঁধে স্কুল ব্যাগের বোঝা, মাথায় পড়ালেখার চিন্তা ও অবসর সময়েও পড়ার চাপ। সময়ের অভাবে একটি শিশু খেলবে আর কি, দিন শেষে যদিও বা খাবার টেবিলে একটু খেলার সুযোগ পায় সেটি হয়ত বা মা কিংবা বাবার ফোনে। একই সাথে যেই সময়ে মাঠে কিংবা উঠানে গিয়ে খেলার বয়স সেই বয়সে ফোন নিয়ে অথবা কম্পিউটার নিয়ে পড়ে থাকার কারণে শিশুরা শারীরিক স্বাস্থ্য যেমন চোখে সমস্যা, স্থুলতা ইত্যাদির মতো সমস্যায় ভুগছে, হয়ে যাচ্ছে অন্তর্মুখী ও অসামাজিক।
তবে কি আমাদের সমাজের ছেলে-মেয়েরা এমনইভাবে বেড়ে উঠবে? আমাদের দেশের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, ধারাবাহিকতা ও প্রাণকে রক্ষা করা তাদের হাতেই, কিন্তু তারাই যদি এসব থেকে অজ্ঞাত থাকে তাহলে কিভাবে তা সম্ভব হবে? উন্নত দেশগুলোতে যেমন তাদের নিজস্ব খেলাগুলোর নিয়মিত চর্চা হয়, একই সাথে বাকি দেশগুলোতেও তাদের খেলাগুলোকে ছড়িয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা রয়েছে, আমাদেরও উচিত সেই পথ অনুসরণ করা। কিভাবে বিলুপ্ত প্রায় খেলাগুলোকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করা যায় এবং নতুন প্রজন্মের সামনে গ্রামীণ খেলাগুলোকে প্রদর্শন করা যায় তার ব্যবস্থা করতে হবে। লোকজ খেলাগুলোকে স্কুল-কলেজের বার্ষিক ক্রীড়ার অন্তর্গত করতে হবে। জাতীয় পর্যায়েও কিছু খেলার আয়োজন করা যেতে পারে, এতে করে এসব খেলার গুরুত্বও বাড়বে। আমাদের জাতীয় খেলা হা-ডু-ডুর সাথে পরিচিত আছে এমন শিশু-কিশোরের সংখ্যা হাতে গোনা কয়েকটা এখন, নিয়ম জানা তো দূরেই থাক তবে। এই খেলার চর্চাও বাড়াতে হবে।
শিশুরা যেহেতু খেলতে পছন্দ করে, তাহলে খেলতে খেলতেই শুরু হোক খেলাগুলোকে বাঁচিয়ে রাখার প্রচেষ্টা।
লেখাটি নিয়ে মতামত