সব মানুষই নাকি সমান। তোমরাই বলো তো, সব মানুষ কি সমান হতে পারে? মানুষের মাঝে তো কত ভিন্নতা! ছেলে, মেয়ে, লম্বা, খাটো, কালো, সাদা, মোটা, চিকন আরও কত কী! আবার সবার পদবি, কাজের ক্ষেত্র, পেশা এসবও তো আলাদা হয়! তাহলে সবাই সমান হলো কী করে? বলো তো!
আসলে এখানে সমতা বলতে সেই সমতাকে বোঝানো হয়েছে যা মানুষের শারীরিক কিংবা পেশাগত পদমর্যাদা অথবা বিত্তের ওপর নির্ভরশীল নয়! এই সমতা বলতে বোঝানো হচ্ছে মানুষের সম-অধিকারকে। মানুষ হিসেবে আমাদের যেটুকু সম্মান ও অধিকার প্রাপ্য তা ধর্ম, বর্ণ, জাতি, শিক্ষা নির্বিশেষে সকল ক্ষেত্রে প্রাপ্য। কিন্তু এই সাধারণ কথাটা মানবজাতিকে হায় কে বোঝাবে!
আমরা প্রায়ই আমাদের আশেপাশে শুনতে পারি যে, “ও কালো, ও ফর্সা কিংবা ও শ্যামলা”। সাদা চামড়ার অধিকারী হয়ে মানুষ নিজেকে ভাবে উচ্চ পর্যায়ের, আর কালো চামড়ার মানুষের এই সমাজে বাঁচতে হয় হীনম্মন্যতা নিয়ে। কিন্তু এসব ভেদাভেদ আসলে কেন শুরু হলো? গায়ের রঙ কি কারও দক্ষতা পরিমাপ করতে পারে নাকি কারও অধিকারকে? আর তোমরা কি জানো যে এসব নিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকায় এতটাই ভেদাভেদ সৃষ্টি হয়েছিল যে নেলসন ম্যান্ডেলাকে এর বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে জেলে থাকতে হয়েছিল ২৭ বছর!
হ্যাঁ! ঠিক শুনেছ, ২৭ টা বছর! বর্ণবাদ নিয়ে আন্দোলন করায় তাঁর বিরুদ্ধে সরকার উৎখাতের অভিযোগ এনে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এরপর থেকেই শুরু হয় তাঁর দীর্ঘ কারাজীবন যা থেকে মুক্তি মেলে ২৭ বছর পর।
এগুলো কিন্তু পুরোনো কাহিনি। কিন্তু এই বৈষম্যগুলো কিন্তু এখনও পুরোনো হয়ে যায় নি। বরং আধুনিক বিশ্বেও বৈষম্যের এই ঘড়ি যেন দিন দিন আরও বেশি করে ঘুরছে!
আচ্ছা কেন এত বৈষম্য বলতে পারো? এত বৈষম্যের পেছনে কারণ একটাই তা হলো “প্রতিটা ক্ষেত্রে মানুষের মাঝে সৃষ্টি হওয়া বিভাজন”। এত এত বিভাজনের ফলে সৃষ্টি হয় এক অসুস্থ প্রতিযোগিতা যার ফলে সৃষ্টি হয় বৈষম্য।
“তুমি কমার্স নিয়েছ? আমি তো নিয়েছি সায়েন্স। আমি তোমার চেয়ে বেশি ভালো,আমি ২ তালায় থাকি, তুমি থাকো ৫ তালায়, আমি বেশি ভালো জায়গায় থাকি, আমার দেশ, তোমার দেশ, আমার গায়ের রঙ, তোমার গায়ের রঙ, আমার রেজাল্ট, তোমার রেজাল্ট, আমার ধর্ম, তোমার ধর্ম!” আরও কত শত কিছু! ছোট ছোট বিষয় থেকে শুরু করে বড় বড় বিষয় পর্যন্ত শুধু বৈষম্য আর বৈষম্য! কিন্তু আমরা কি ভেবে দেখেছি যে আমাদের লড়াই আমাদের নিজেদের সাথে কেন হচ্ছে?
প্রতিটি প্রাণীকূলের মাঝে দেখা যায় ঐক্য, শান্তি ও সমতা। তারা কখনো নিজেদের মাঝে লড়াই করে না। তাদের লড়াইটা হয় অন্য কোনো প্রাণীর সাথে যারা কিনা তাদের ক্ষতি করতে চাচ্ছে। কিন্তু মানবজাতি এত বুদ্ধি সম্পন্ন হয়েও কীভাবে নিজ জাতির সাথেই যুদ্ধে লিপ্ত হয় তা আসলেই ভাবার বিষয়! অথচ পশু-পাখি, মানুষ সবারই মিলে মিশে লড়াইটা হওয়ার কথা ছিল প্রতিকূল প্রকৃতির বিরুদ্ধে যা অতীতে গুহায় বাস করা মানুষদের মধ্যে দেখা যেত। তাদের মধ্যে ঐক্য ছিল কারণ তারা জানত যে তাদের লড়াইটা নিজেদের সাথে না! কিন্তু সময় অতিবাহিত হতে হতে বর্তমানে এসে একদিকে যেমন মানুষ তার বুদ্ধি দিয়ে এই পৃথিবী ছাড়িয়ে অন্য গ্রহকেও জয় করার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে অপরদিকে অসমতার ভীড়ে মানুষ হারাচ্ছে নিজস্ব নীতি, মনুষ্যত্ববোধ ও ঐক্য।
মানুষ এক হলে কি না পারে করতে! বর্তমান পৃথিবীই তার উদাহরণ। আকাশে, সমুদ্রের নিচে এমনকি চাঁদেও মানুষ রেখেছে তার পদচারণা। সবই সম্ভব হয়েছে মানুষের একতা ও বুদ্ধিমত্তার কারণে। কিন্তু মানুষের একতার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় এই অসমতা ও ভেদাভেদ!
এত শত ভেদাভেদে পৃথিবী ও মানবজাতি উভয়ই ধ্বংসের পথে। গোলাগুলি, রাহাজানি, যুদ্ধে পৃথিবীর কিছু দেশ প্রায় বিধ্বস্ত। শিশুরা বড় হচ্ছে এসব মনুষ্যত্বহীন কার্যক্রম দেখে।
একটা শিশু শৈশবে যা দেখবে তার প্রভাব থাকবে সারাজীবন, হয় কম না হয় বেশি। ছোট থেকেই বাচ্চাদের তুলনা করা হয় অন্যদের সাথে! পড়তে না চাইলে বলা হয় ‘তুই কি রিকশাওয়ালা হবি’! এই ধরণের কথা শিশুর মনে বিরূপ প্রভাব ফেলে! এই কথার মাধ্যমে সে শিক্ষার গুরুত্ব বুঝে না, সে ভাবে রিকশা চালানো নিচু পেশা আর রিকশাচালকের সম্মান প্রাপ্য না! আদৌ কি তাই! আমরা যে জানতাম সব পেশাই সমান! কথাটি কি ভুল? না কথাটি ভুল না। ভুল আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি, ভুল আমাদের মানসিকতা! প্রতিটি পেশাই সমান গুরুত্বপূর্ণ। যদি রিকশাওয়ালা আর রিকশা না চালায়, কৃষক আর ফসল না ফলায় তাহলে কেমন হবে ভেবেছ? অথচ আমরা তাদেরকে নিচু বলে আখ্যা দেই।
এই সমাজে ছেলে-মেয়ের ভেদাভেদ প্রতিটা মুহূর্তে দেখা যায়। কিন্তু এই সমাজ চালনার দায়িত্ব যে তাদের উভয়ের, তাহলে অধিকার প্রদানের বেলায় কেন এত কৃপণতা!
আমাদের সর্বদা মনে রাখা উচিত-“সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।” আমরা সবাই মানুষ-এটাই হলো আমাদের প্রথম পরিচয়। মানবজাতি এগিয়ে যাক-ভেদাভেদ না বরং বৈচিত্র নিয়ে।
লেখাটি নিয়ে মতামত